‘‘জলাশয় সংরক্ষণের গুরুত্ব’’ শীর্ষক আলোচনা সভা
স্থান: এন. এস. এস ট্রেনিং সেন্টার, আমতলী, বরগুনা।
তারিখ: ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯
প্রতিবেদন তৈরী: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯
উপকূলীয় জেলা বরগুনা। এই জেলার আমতলী উপজেলায় সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে একাধিক নদী, শাখা নদী ও খাল। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে আমতলী উপজেলায় ৬টি নদী, ৭২টি খাল ও ১৩,৭২০টি পুকুর রয়েছে। পায়রা, রামনাবাদ, বাশবুনিয়া, আগুনমুখা, আন্দারমানিক ও চাওড়া নদীতে দখল দারিত্ব তেমন একটা না থাকলেও খালগুলোর অবস্থা ভালো নেই। কিন্তু কৃষি নির্ভর এ উপজেলার মানুষ এর সাথে নদী ও খালের পানির সাথে জীবন-জীবিকার সম্পর্ক। এখানকার পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতেও জলাশয়গুলো টিকিয়ে রাখা অপরিহার্য। খালগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য আমতলী উপজেলাবাসী দীর্ঘদিন যাবত সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে নানাভাবে দাবী জানিয়ে আসছিলো। কিন্তু প্রশাসনের কাছ থেকে ইতিবাচক সারা না পেয়ে পরিবেশবাদী সংগঠন বেলা’র কাছে এখানকার জলাশয় রক্ষায় কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহনের দাবী জানালে বেলা বিগত ২৬-২৮ আগষ্ট ২০১৯ তারিখে এ উপজেলার উল্লেখযোগ্য খালগুলো পরিদর্শন করে। বেলা’র পরিদর্শনে সুবন্ধির খাল, বাসুকী খাল, আড়পাঙ্গাশিয়া খাল, কলাগাছিয়া খাল, গোজখালী খাল, কুকুয়া খাল, শিয়ালগুনিয়ার খাল,
আঠারগাছিয়ার খাল ও পাটয়ু ার খালে দখল, দূষণ, অপরিকল্পিত ¯ুইø জগেট, বাঁধ এমনকি খালের উপর দিয়ে পাকা সড়ক নির্মাণেরও সত্যতা পাওয়া গেছে। এ সংকটাপনড়ব অবস্থা নিরসনের লক্ষে এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে জলাশয়গুলোর বর্তমান অবস্থা তুলে ধরতে ‘বেলা’ ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে আমতলীর এন. এস. এস ট্রেনিং সেন্টারে ‘‘জলাশয় সংরক্ষণের গুরুত্ব’’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।
বিশিষ্ট সাংবাদিক ও নেট মেম্বার বেলা জনাব মোঃ সোহরাব হোসেন এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আমতলী উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব মনিরা পারভীন এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেলা পরিষদের সদস্য সাহিনুর তালুকদার, বরগুনা জেলা আইনজীবি সমিতির সহসভাপতি জনাব এ্যাডভোকেট এম. এ. কাদের এবং অবসরপ্রাপ্ত প্রভাষক জনাব মোঃ আনোয়ার হোসেন। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জনাব শাহাবুদ্দিন পানড়বা, নির্বাহী পরিচালক নজরুল স্মৃতি সংসদ (এন.এস.এস) এবং নেট মেম্বার বেলা। সভার শুরুতে ¯া^ গত বক্তব্য রাখেন জনাব লিংকন বায়েন, বিভাগীয় সমšয়^ কারী, বেলা, বরিশাল। সভায় অন্যান্যের মধ্যে মলূ ্যবান মতামত ব্যক্ত করে বক্তব্য রাখেন জনাব মোঃ হোসেন আলী কাজী, মোঃ মহিউদ্দিন খোকন, এ কে এম খায়রুল বাশার বুলবুল, মোঃ সফিকুর রহমান, মোঃ সাইফুল ইসলাম স্বপন, সুজাউদ্দিন মাহমুদ প্রমুখ। সভায় বক্তাগন বলেন, ‘‘বরগুনার আমতলী উপজেলা একটি নদী বেষ্টিত অঞ্চল। এর মাঝে আছে অসংখ্য খাল ও শাখা খাল। কৃষি নির্ভর এ অঞ্চলের মানুষ এখন বর্ষাকালে পানিতে বন্দী থাকে আবার শুস্ক মৌসুমে পানির জন্য হাহাকার করে। একটি স্বার্থান্বেষী মহল নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্য হাজারো মানুষের দুভোর্ েগর কারন হয়ে দাড়িয়েছে। সেই সাথে প্রশাসনের অপরিকল্পিত প্রকল্প প্রনয়ন ও বাস্তবায়ন এখন সাধারন মানুষের ভোগান্তির সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে খালে অপরিকল্পিত বাঁধ ও ¯øুইজগেট থাকায় বর্ষাকালে পানিবদ্ধতা লেগেই থাকে। তখন ফসলের আবাদ বন্ধ থাকে। শুস্ক মৌসুমে চারদিকে পানির জন্য হাহাকার দেখা যায়। ¯øুইসগেটগুলো তখন পানির স্তরের উপরে থাকায় কৃষকরা পানি থেকে বঞ্চিত থাকে। এ কারনে কৃষকরা রবিশস্য আবাদে ভোগান্তির মধ্যে পরে। যে কারনে দেখা দেয় খাদ্যসংকট। এ অবস্থা নিরসনে প্রশাসনের কাছে অসংখ্য বার প্রতিকার চাওয়া হয়েছে। জনমত সৃষ্টিকরা হয়েছে। মানব বন্ধন করে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। এমনকি প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের সরেজমিনে দুরবস্থা দেখানো হয়েছে। কিন্তু আজও কোন প্রতিকার মেলেনি। শুনেছি উপজেলার ঐতিহ্যবাহী খাল সুবন্ধার উনড়বয়নে কয়েক কোটি টাকার প্রকল্প মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্প অনুমোদন বা খালটি পুনরুদ্ধারে আজও কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। তাই আমরা সুবন্ধির খালসহ উপজেলার সকল জলাশয় রক্ষায় ‘বেলা’র আইনগত সহযোগীতা কামনা করছি। ৪টি ইউনিয়নের ভীতর দিয়ে প্রবাহিত সুবন্ধির খালটিতে ¯া^ র্থান্বেষী মহালের বাঁধ ও অপরিকল্পিত ¯ুøইজ গেটের কারনে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ দুর্ভোগের সন্মুখীন হয়েছে। এতবড় একটি সমস্যা অথচ প্রশাসন নির্বিকার।খালটিতে নাব্যতা সংকট থাকায় পানিপ্রবাহ বন্ধ রয়েছে। ভরে গেছে কচুরিপানায়। শুস্ক মৌসুমে খালপাড়ের মানুষদের টেকা দায় হয়ে পরেছে। গবাদি পশু এই খালের পানি ব্যবহারের কারনে রোগাμান্ত হয়ে পড়েছে। মাছের পচন রোগ হয়েছে। এসব জলাশয়ের মাছ বাজারে উঠলেও কেউ কিনতে চায় না। তাই যে কোন সময় এ সকল বদ্ধ জলাশয় হতে মহামারি ছড়িয়ে পরতে পারে। তারা আরও বলেন, আমতলী উপজেলা ভূমি অফিস কর্তকৃ চিহ্নিত দখলের তালিকায় দেখা যায় উপজেলার ১৫টি নদী ও খালের দখলদারের সংখ্যা ২৭৫। দখল করে ঘরবাড়ীর সংখ্যা ২৯২টি। দখলের তালিকা করলেও আজ পর্যš Í উচ্ছেদ কার্যμম পরিচালনা করছে না। এ অবস্থা চলতে পারে না। আমরা প্রশাসনের কাছে দ্রæত সমাধান চাই। সুবন্ধির খাল,গোজখালী ও আঠারোগাছিয়ার খালে স্থানীয় জনতা অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ দিয়ে চলাচলের রাস্তা নির্মান করেছেন। পরবর্তীতে তা পাকা সড়কে পরিনত হওয়ায় এসব অঞ্চলে জলবদ্ধতা স্থায়ী রুপ নিয়েছে। দীর্ঘদিন যাবত এ অবস্থা চললেও জনগুরুত্বপূর্ণ এই খালগুলোর সুরক্ষায় স্থানীয় প্রশাসন কোন প্রকার উদ্যোগ গ্রহন করেনি। আমরা এর স্থায়ী সমাধান চাই’’।
এ দুরাবস্থার স্থায়ী নিরসনকল্পে আলোচনা সভায় বক্তারা যে দাবীগুলো গুলো প্রশাসনের কাছে তুলে ধরেছেন তা হলঃ
(১) অপরিকল্পিত বাঁধ কেটে ফেলা।
(২) পরিকল্পিত ¯ুইø জগেট নির্মাণ
(৩) দখল উচ্ছেদ
(৪) কৃষি জমি দেখিয়ে জলাশয়কে বন্দোব¯ Í না দেয়া
(৫) বাঁধ দিয়ে মাছ চাষের সুযোগ না দেয়া
(৬) নিয়মিত পুন:খনন বা সংস্কার এবং
(৭) রাজনৈতিক ও প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করা।
বিশেষ অতিথিরা তাঁদের মূল্যবান বক্তব্যে বলেন, ‘‘নদীকে কেন্দ্র করে আমাদের সভ্যতা। নদীকে কেন্দ্র করেই আমাদের জীবন-জীবিকা। অথচ এই নদী-খাল সহ কল জলাশয় গুটিকয়েক ¯া^ র্থান্বেষী মানুষের হস্তক্ষেপে হারিয়ে যেতে বসেছে। এ অবস্থা চলতে পারে না। আমরা এর প্রতিকার চাই। প্রকৃতির সাথে লড়াই করে আমরা বেঁচে থাকতে পারবো না। প্রকৃতি বাঁচলে আমরাও বাঁচবো। তাই এখনই সময় আসুন এ সমস্যার সমাধান করি’’। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি তাঁর মূল্যবান বক্তব্যে বলেন, ‘‘এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য আমি প্র মেই ‘বেলা’কে ধন্যবাদ জানাই। জনমানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের উদ্দেশ্যে এ মঞ্চ সত্যিই প্রশংসনীয়। বেলা’র অনেক সাকসেস আমার জানা আছে। সে তুলনায় সুবন্ধির খালের বাঁধ বা দখল-দূষণ সামান্য ব্যাপার। বেলা জনস্বাথের্ আইনী সহায়তা দিবে আমরা আমাদের অবস্থান থেকে মানুে ষর দুঃখ লাঘবে কাজ করে যাব। এখানকার মানুষের জলাশয় সংμান্ত সংকটের কথা আমি জানি। ইতিমধ্যে ৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়েছে। যা পাইপ লাইনে আছে। প্রকল্প অনুমোদন হলে সাধারন জনতার দাবী মোতাবেক খালের সংস্কার কার্যμম পরিচালনা করা হবে। দখল উচ্ছেদ করা হবে। ৫০টি পরিবার বাঁচাতে সুবন্ধির খালে যে বাঁধ দেয়া হয়েছে তাতে ৮০ হাজার মানুষের দুভোর্গ কোনো ভাবেই মেনে নেয়া যায় না। তাই অচিরেই এ বাঁধ উন্মুক্ত করে দেয়ার জন্য আমার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। সেই সাথে চাওরা ইউনিয়নের ৫০টি পরিবারের জন্যও রিং
বাঁধ দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে’’। অনুষ্ঠানের সভাপতি তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘‘ধান- নদী -খাল নিয়ে আমাদের পরিচয়। কিš ‘ প্রভাবশালী মহাল অসাধু কিছু সরকারী কর্মচারীর সহযোগীতায় জলাশয়গুলোকে লিজ নিয়ে শ্রেনী পরিবর্তন করছে বা বাঁধ দিয়ে মাছের চাষ করছে। এতে ভোগান্তিতে পড়ছে হাজারো মানুষ। এতে করে কৃষিকার্যμম ব্যহত হওয়ার পাশাপাশি বন্ধ হয়ে গেছে নৌযোগাযোগ। সংকটাপনড়ব হয়েছে পরিবেশ। কৃষক বাঁচলে আমরাও বাঁচবো। বাঁচবে দেশ তাই এখনই সময় জলাশয়গুলো সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার। খালের সীমানা নির্ধারন করে দখল উচ্ছেদের পাশাপাশি পরিকল্পিতভাবে যদি পানির ¯া^ ভাবিক প্রবাহ বজায় রাখা যায় এবং খালগুলো খনন করা হয় তাহলে এ সংকট থেকে মুক্ত হওয়া যাবে। সেই সাথে খালপাড়ের মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক কাজে ব্যবহৃত হবে এ পানি। কৃষকদের সেচ সুবিধা সহ বৃষ্টি ও বন্যার পানি নিস্কাশনের ক্ষেত্রে সহায়ক হবে ঐতিহ্যবাহী এ খালগুলো। এখনো সংশ্লিষ্ট প্রশাসন দলীয় প্রভাবমুক্ত হয়ে নিঃস্বার্থভাবে দায়িত্ব পালন করলেই খালগুলো পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। তাই আসুন এ ব্যাপারে আমরা জনমত গড়ে তুলি। সকলে ঐক্যবদ্ধ হই। এ অবস্থা হতে মুক্তি পেতে সামাজিক আন্দোলনেরও কোনো বিকল্প নেই বলে তিনি জানান। পরিশেষে উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
বেলা, বরিশাল।
তারিখ: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯