আজ (১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪) নারায়নগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নের পিরোজপুর, জৈনপুর, ছয়হিস্যা, চর ভবনাথপুর, ভাটিবন্দর এবং রতনপুর মৌজায় বালু ফেলে কৃষি জমি ভরাট বন্ধকরণে, কৃষি জমি সংরক্ষণে ও পুনরুদ্ধারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় হস্তক্ষেপ কামনায় একটি পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। প্রেরিত পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নারায়নগঞ্জ জেলাধীন সোনারগাঁও উপজেলাস্থ পিরোজপুর ইউনিয়নের উল্লেখিত মৌজাগুলোর কৃষিজমি, নিচুজমি সরকারের ইরি স্কীম এর অর্ন্তভুক্ত। এসব কৃষিজমি ভরাট করে ইউনিক প্রপার্টিজ ডেভেলপমেন্ট লিঃ নামক একটি বেসরকারি আবাসন কোম্পানি ২০১১ সালে “সোনারগাঁও রিসোর্ট সিটি” নামক আবাসন প্রকল্প গ্রহণ করে। কোম্পানিটি তার তথাকথিত প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ২৩৫০ বিঘা জমি জবর দখল করে মাটি ভরাট শুরু করে। এলাকাবাসীকে হুমকি প্রদর্শন ও জোরপূর্বক টাকা গ্রহণ করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়। উল্লেখিত ৬ টি (ছয়) মৌজায় বেআইনীভাবে মাটি ভরাটের জন্য স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইউনিক প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সোনারগাঁও ইকোনোমিক জোনকে বিভিন্ন সময়ে অভিযুক্ত ও জরিমানা করেছে।
সরকারি সংস্থাগুলোর আইনগত নির্দেশ অমান্য করে জোরপূর্বক উল্লেখিত মৌজাসমূহে মাটি ভরাট অব্যাহত থাকলে কৃষকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) কৃষিজমি ও জলাশয় রক্ষায় একটি জনস্বার্থমূলক মামলা (নং ১৬৮৩/২০১৪) দায়ের করে। মামলার প্রাথমিক শুনানী শেষে ২রা মার্চ, ২০১৪ এ হাইকোর্ট বিভাগ উল্লেখিত মৌজাসমূহে মাটি ও বালু ভরাট নিষিদ্ধ করে। ইউনিক প্রোপার্টি আদালতের আদেশ অমান্য করলে বেলার আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৪ আগস্ট, ২০১৮ আপীল বিভাগ উল্লেখিত মৌজাসমুহে মাটি ও বালু ভরাট বন্ধ ও ভরাটকৃত মাটি অপসারণের নির্দেশ প্রদান করেন।
প্রেরিত এ পত্রের মাধ্যমে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিগণ উল্লেখ করেন, পরবর্তীতে কোম্পানীটির মালিক জনাব মোঃ নুর আলী চতুরতার আশ্রয় নিয়ে এবং আদালতের আদেশ গোপন করে একই মৌজায় আবাসন প্রকল্পের নাম পরিবর্তন করে তথাকথিত “সোনারগাঁও ইকোনোমিক জোন” তৈরির জন্য মাটি ও বালু ভরাট শুরু করে এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) থেকে একটি প্রাক-যোগ্যতা লাইসেন্স গ্রহণ করে। এর বিরুদ্ধে বেলা আবারো আদালতের শরণাপন্ন হয়। দফায় দফায়, দীর্ঘ ও চূড়ান্ত শুনানী শেষে বিগত ০২ ডিসেম্বর, ২০২০ আদালত ১১ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় প্রদান করেন। রায়ে হাইকোর্ট মামলাভুক্ত মৌজাসমূহে বিস্তীর্ণ কৃষিজমি, নিচু জমিতে ইকোনোমিক জোন তৈরির উদ্দেশ্যে বালু ভরাটের কার্যক্রমকে অবৈধ ঘোষণা করেন এবং কি পরিমাণ ভূমি দখল ও বালু দিয়ে ভরাট করা হয়েছে তার পরিমাণ ও ভরাটের কারণে কৃষির ক্ষতিপূরণ যৌথভাবে নির্ধারণ করার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর এবং স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ প্রদান করেন। একইসাথে আদালত ভরাটকৃত কৃষিজমি ও নিচু জমি ইউনিক প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড ও তথাকথিত সোনারগাঁও ইকোনোমিক জোন লিমিটেড এর খরচে পুনরুদ্ধার করে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সহকারি কমিশনার (ভূমি), সোনারগাঁও উপজেলা, নারায়নগঞ্জ এবং উপ-পরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর, নারায়নগঞ্জ জেলা কার্যালয়কে নির্দেশ প্রদান করেন।
হাইকোর্ট প্রদত্ত রায়ের বিরুদ্ধে বিবাদীগণ একাধিক সিভিল পিটিশন ফর লীভ টু আপীল (নং ২৮০২/২০২১, ২৮৮৭/২০২১, ১৫৪১/২০২২) দায়ের করে যা চূড়ান্ত শুনানীর অপেক্ষায় আছে। সিভিল পিটিশন ফর লীভ টু আপীলসমূহ আমলে নিয়ে মাননীয় চেম্বার আদালত হাইকোর্ট বিভাগ প্রদত্ত রায়ের উপর স্থগিতাদেশ প্রদান করেন। প্রেরিত পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রীট মামলার রুল জারির তারিখ থেকে (০২ মার্চ, ২০১৪ সাল) শুরু করে মাননীয় চেম্বার আদালত কর্তৃক স্থগিতাদেশ জারির পূর্ব পর্যন্ত (০৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২) সকল সময় মামলাভুক্ত মৌজাসমূহে মাটি ও বালু ভরাটের উপর হাইকোর্ট বিভাগ ও আপীল বিভাগের স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা ছিল। ভরাটকৃত মাটি সরাতে এমনকি আপীল বিভাগ কর্তৃক ১৪ আগষ্ট, ২০১৮ তারিখে নারায়নগঞ্জের জেলা প্রশাসককে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছিলো এবং এ বিষয়ে স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে ব্যাখ্যা প্রদান করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো।
রায়ে স্থগিতাদেশের পরে উল্লেখিত ৬টি (ছয়) মৌজায় মাটি বা বালু ফেলা বন্ধ থাকলেও সিভিল পিটিশন ফর লীভ টু আপীলগুলো আপীল বিভাগে বিচারাধীন থাকা অবস্থায় সোনারগাঁও উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়ন এর অধীন মামলাভুক্ত ছয়হিস্যা ও চর ভবনাথপুর মৌজায় নতুন করে মাটি ভরাট এমনকি কৃষকের ফসলের উপর বালু ফেলার কার্যক্রম শুরু হয়। বেলা আপীল বিভাগে মাটি ভরাটের কার্যক্রম বন্ধে একটি নিষেধাজ্ঞার আবেদন করে। আবেদনের শুনানি শেষে আপীল বিভাগের মাননীয় চেম্বার জজ বিগত ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৩ তারিখে নিষেধাজ্ঞার আবেদনটি মঞ্জুর করেন এবং মামলাভুক্ত ৬টি (ছয়) মৌজায় মাটি ভরাটের উপর আবারো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। কিন্তু মাননীয় চেম্বার জজের নিষেধাজ্ঞার আদেশ অমান্য করে মাটি ভরাট কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে যা নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন কোনো কার্যকরী উদ্যোগ নেয়নি।
প্রেরিত এ পত্রের মাধ্যমে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিগণ উল্লেখ করেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বার বার অনুশাসন দিয়েছেন যে উন্নয়ন করতে গিয়ে কৃষিজমি বিনষ্ট করা যাবে না। তিনি সকলকে কৃষিতে সম্পৃক্ত হবার আহবান জানিয়ে এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি না রেখে সেখানে একটা তরকারি গাছ বা মরিচ গাছ হলেও লাগানোর তাগিদ দিয়েছেন। বর্তমান সরকার জাতীয় কৃষি নীতি, ২০১৮ প্রণয়ন করেছে যার মূল লক্ষ্য শস্য উৎপাদনের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশ বেসরকারি অর্থনৈতিক জোন নীতিমালা, ২০১৫ এর অনুচ্ছেদ ৩ অনুসারে উর্বর জমিতে বেসরকারি অর্থনৈতিক জোন স্থাপন করার অনুমোদন প্রদান করা যাবেনা। এছাড়াও ভূমি দখলরোধ ও ভূমি অধিকার নিশ্চিতকরণে সরকার প্রণয়ন করেছে ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩।
কৃষিজমি ও জলাশয় রক্ষায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় বক্তব্য ও অবস্থান এবং কৃষিজমি ও জলাশয় রক্ষায় সরকারের বিভিন্ন আইন, নীতি ও পরিকল্পনা জনমনে আশা সঞ্চার করলেও বিভিন্ন সময়ে যেভাবে ভূমিদস্যুদের দ্বারা কৃষিজমি ও জলাশয় ভরাট করা হচ্ছে তা আশঙ্কাজনক বলে মনে করেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিগণ। তাঁদের মতে, প্রশাসনের উদাসীনতা ও যোগসাজশে কৃষিজমি ভরাট মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন প্রতিপালনে অনেক ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে যার প্রমাণ ৬টি মৌজায় কৃষিজমি তথাকথিত “সোনারগাঁও ইকোনোমিক জোন” এর নামে ইউনিক প্রপার্টিজ ডেভেলপমেন্ট লিঃ কর্তৃক অবৈধভাবে ভরাট। ইতোপূর্বে আদালতের আদেশ বাস্তবায়নে এবং মাটি ভরাটরোধে নি¤œস্বাক্ষরকারীগণ বিবাদীগণকে অনুরোধ জানালেও কোন কার্যকরী ব্যবস্থা গৃহিত হয়নি।
প্রেরিত এ পত্রের মাধ্যমে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিগণ নারায়নগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নের পিরোজপুর, জৈনপুর, ছয়হিস্যা, চর ভবনাথপুর, ভাটিবন্দর এবং রতনপুর মৌজায় ইকোনমিক জোনের নামে বালু ফেলে কৃষি জমি ভরাট বন্ধে ও ভরাটকৃত বালু অপসারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। একইসাথে স্থানীয় প্রশাসনকে আদালতের আদেশ বাস্তবায়নের জন্য এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ কর্র্তৃক কৃষিজমিতে তথাকথিত “সোনারগাঁও ইকোনোমিক জোন” স্থাপনের জন্য ইউনিক প্রপার্টিজ ডেভেলপমেন্ট লিঃ এর মালিক জনাব মোঃ নুর আলীকে প্রদত্ত প্রাক-যোগ্যতা লাইসেন্স বাতিলের নির্দেশ প্রদানের জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। প্রেরিত পত্রে স্বাক্ষরকারীগণের দৃঢ় বিশ্বাস, কৃষিজমি রক্ষায় ও ভূমি দস্যুদের প্রতিরোধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রদত্ত নির্দেশনাবলী দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে। পত্রে স্বাক্ষরকারীগণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করেছেন।
পত্রটিতে স্বাক্ষর করেছেন-
১. সুলতানা কামাল, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন;
২. খুশী কবির, সমন্বয়কারী, নিজেরা করি;
৩. শামসুল হুদা, নির্বাহী পরিচালক, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি);
৪. ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি);
৫. ফারুখ ফয়সল, নির্বাহী পরিচালক, আইন ও শালিস কেন্দ্র;
৬. এস এম রেজাউল করিম, আইন উপদেষ্টা, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এবং
অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, জেলা ও দায়রা জজ আদালত;
৭. জাকির হোসেন, প্রধান নির্বাহী, নাগরিক উদ্যোগ;
৮. আলমগীর কবির, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা);
৯. পাভেল পার্থ, পরিচালক, শিক্ষা সংস্কৃতি, বৈচিত্র্য ও জলবায়ু, বাংলাদেশ রিসোর্চ সেন্টার ফর ইনডিজেনাস লনেজ (বারসিক)।