আজ (৩১ জানুয়ারি, ২০২৩) চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার, হাবিলাস দ্বীপ ইউনিয়নের চরকানাই, হুলাইন, পাচুরিয়া এবং হাবিলাসদ্বীপ গ্রামে শিল্প প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের বিরুদ্ধে ২৬ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে রীট পিটিশন (নং ৪৪০/২০১৫) এ রায়ের মাধ্যমে প্রদত্ত নির্দেশনাবলী অবিলম্বে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার জন্য বিবাদীগণ (সরকারী সংস্থাসমূহ) এর প্রতি নির্দেশ প্রদান করেছেন আদালত। একই সাথে চট্রগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার ৫ নং হাবিলাস দ্বীপ ইউনিয়নের চরকানাই, হুলাইন, পাচুরিয়া এবং হাবিলাসদ্বীপ বাসিন্দাদের/ গ্রামবাসীদের নিয়মিত পানি সরবারাহের জন্য সচিব, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়; সচিব, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়; সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়; সচিব, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়; মহাপরিচালক, পানি উন্নয়ন বোর্ড; প্রধান প্রকৌশলী, জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদপ্তর; জেলা প্রশাসক, চট্টগ্রাম; চেয়ারম্যান, পটিয়া উপজেলা এবং সহকারি প্রকৌশলী,জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদপ্তর, পটিয়া এর প্রতি অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করেন আদালত। সেই সাথে এ রায়ের মাধ্যমে প্রদত্ত আদালতের নির্দেশনাবলী বাস্তবায়ন সাপেক্ষে আগামী ৩ মাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন প্রদানের জন্য ৯ নং বিবাদী (মহাপরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর) – কে নির্দেশ প্রদান করেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) কর্তৃক দায়েরকৃত একটি আবেদনের শুনানী শেষে জনাব বিচারপতি মাহমুদুল হক এবং জনাব বিচারপতি মোঃ মাহমুদ হাসান তালুকদার এর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বিভাগের ডিভিশন বেঞ্চ এ আদেশ প্রদান করেন।
উল্লেখ, আটটি শিল্প প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার, হাবিলাস দ্বীপ ইউনিয়নের চরকানাই, হুলাইন, পাচুরিয়া এবং হাবিলাসদ্বীপ গ্রামে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্ত কর্তৃক স্থাপতি ৩৫০টি টিউবওয়েল বিকল হয়ে পড়লে গ্রামগুলোর প্রায় ৩০ হাজার মানুষ সুপেয় পানির তীব্র সংকটে পরে। যে আটটি শিল্প প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে গ্রামগুলোতে পানি শূণ্যতা তাদের মধ্যে ছয়টির পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই এবং বেশির ভাগই বর্জ্য শোধনাগার প্ল্যান ছাড়া পরিচালিত হচ্ছিল। তাদের সৃষ্ট দূষণে পার্শ্ববর্তী বোয়লখালী, গরুলতা এবং আলম ডাঙা খালের পানি দূষিত হয়ে পড়লে গ্রামবাসী সুপেয় পানির পাশাপাশি চাষাবাদের পানিরও তীব্র সংকটে পড়ে। পরিবেশ অধিদপ্তর তিনটি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করলেও প্রতিষ্ঠানগুলো আইন অমান্য করে এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে জরিমানাও প্রদান না করে কার্যক্রম অব্যাহত রাখে।
সে প্রেক্ষিতেবাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) আটটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের (১। বনফুল এন্ড কোঃ (ফুড প্রোডাক্টস) ২। বনফুল এন্ড কোঃ (মিনারেল ওয়াটার) ৩। আম্বিয়া নীটিং এন্ড ডাইং লিঃ ৪। আম্বিয়া পাল্প এন্ড পেপার মিলস লিঃ ৫। মোস্তফা পেপার কমপ্লেক্স লিঃ ৬। হাক্কানী পাল্প এন্ড পেপার মিলস লিঃ ৭। আনোয়ারা পেপার মিলস লিঃ ৮। শাহ্ আমানত নীটিং এন্ড ডাইং লিঃ) অনুমোদন বিহীন ও অপরিকল্পিত ভাবে গভীর নলকূপ স্থাপন ও ব্যাপক হারে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন, কারখানার বর্জ্য পার্শ্ববর্তী খাল ও কৃষি জমিতে নিক্ষেপ এবং উক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো কর্তৃক পরিবেশের জন্য বিপদজনক ও দূষণযুক্ত পরিচালনার বিরুদ্ধে প্রতিকার প্রার্থনা করে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন (নং ৪৪০/১৫) দায়ের করে। মামলার চূড়ান্ত শুনানী শেষে বিগত ২৬ নভেম্বর, ২০১৯ তারিখে বিচারপতি জনাব তারিক উল হাকিম ও বিচারপতি জনাব মো: সোহরাওয়ার্দী-এর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ কয়েকটি নির্দেশনা দিয়ে রীট মামলাটি চলমান ঘোষণা করেন।
মামলার শুনানীতে পরিবেশ অধিদপ্তর শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর দূষণ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রদান করে। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড যে সকল প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করে তাতে স্পষ্ট হয় যে গ্রামগুলোতে এখন আর হস্ত চালিত পাম্প বা তারাটিউবওয়েলের মাধ্যমে পানি উত্তোলন সম্ভব নয়। ফলে সরকার মাটির ১৫০ মিটার নীচ থেকে পানি উত্তোলনে সক্ষম এমন পাম্প বসিয়ে এলাকাবাসীর পানি চাহিদা মেটাতে উদ্যোগ নিচ্ছে। সরকারের এমন উদ্যোগ ক্ষয়িষ্ণু ভূগর্ভস্থ পানি স্তরের উপর আরো চাপ সৃষ্টি করবে বলে সরকারের এমন উদ্যোগের বিরোধিতা করে আদালতে বক্তব্য রাখে বেলা’র আইনজীবীরা। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো পাশ্ববর্তী খালের পানি নিয়ে কার্যক্রম চালাবার অনুমতি চাইলে খালের পানি ইতোমধ্যে দূষিত হয়ে পড়েছে এবং তা পরিশোধন করে গ্রামের মানুষের পানির চাহিদা প্রথমে পূরণ করতে হবে, এমন যুক্তিতে বেলা’র পক্ষ থেকে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়। সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের দীর্ঘ শুনানী শেষে মহামান্য হাইকোর্ট পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং জেলা প্রশাসক ও পটিয়া উপজেলা চেয়ারম্যানকে গ্রামবাসীকে অব্যাহতভাবে সুপেয় পানি সরবরাহের নির্দেশ প্রদান করেছেন। আদালত পানি আইন, ২০১৩-এ ধারা (১৭)-এর অধীনে চরকানাই, হুলাইন, পাচুরিয়া এবং হাবিলাসদ্বীপ গ্রামগুলোকে পানি সংকাটাপন্ন এলাকা ঘোষণার বিষয়ে আগামী তিন মাসের মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। একইসাথে আদালত বিবাদী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তরএবং জেলা প্রশাসককে আদালতে আটিটি শিল্প প্রতিষ্ঠান কর্তৃক করা দূষণের পরিমাণ যাচাই করে তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন।
ভবিষ্যতে এই চারটি গ্রামে বিকল্প পানির ব্যবস্থা না করে ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর নির্ভর করে কোন “লাল” বা কমলা-খ শ্রেণির শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হতে পারবে না। পটিয়া উপজেলায় পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া এবং কার্যকরী বর্জ্য শোধনাগার প্ল্যান ছাড়া কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান যেন পরিচালিত হতে না পারে তা নিশ্চিত করতে পরিবেশ অধিদপ্তর কে নির্দেশ দিয়েছেন। আদালতের নির্দেশ প্রতিপালন বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে মেমো প্রস্তুত করে আদালতে দাখিলে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য যে, পানি আইনের অধীনে দেশে কোন এলাকাকে পানি সংকটাপন্ন এলাকা দাবি জানিয়ে এটিই প্রথম আইনী কার্যক্রম।
মামলার বিবাদীগণ হলেন- ১। সচিব, ভূমি মন্ত্রণলয় ২। সচিব, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ৩। সচিব, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ৪। সচিব, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ৫। সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয় ৬। সচিব, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ৭। সচিব, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় ৮। চেয়ারম্যান, জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন ৯। মহাপরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর ১০। মহাপরিচালক, পানি উন্নয়ন বোর্ড ১১। প্রধান প্রকৌশলী, জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদপ্তর ১২। জেলা প্রশাসক, চট্টগ্রাম ১৩। পরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম ১৪। চেয়ারম্যান, পটিয়া উপজেলা ১৫। উপজেলা নির্বাহী অফিসার, পটিয়া ১৬। সহকারী কমিশনার (ভূমি), পটিয়া ১৭। চেয়ারম্যান, ৫নং হাবিলাস দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদ ১৮। সহকারী প্রকৌশলী, জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদপ্তর, পটিয়া এবং বোয়ালখালী উপজেলা, চট্টগ্রাম ১৯। ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বনফুল এন্ড কোঃ (ফুড প্রোডাক্টস) ২০। ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বনফুল এন্ড কোঃ (মিনারেল ওয়াটার) ২১। ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আম্বিয়া নীটিং এন্ড ডাইং লিঃ ২২। ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আম্বিয়া পাল্প এন্ড পেপার মিলস লিঃ ২৩। ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মোস্তফা পেপার কমপ্লেক্স লিঃ ২৪। ব্যবস্থাপনা পরিচালক, হাক্কানী পাল্প এন্ড পেপার মিলস লিঃ ২৫। ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আনোয়ারা পেপার মিলস লিঃ ২৬। ব্যবস্থাপনা পরিচালক, শাহ্ আমানত নীটিং এন্ড ডাইং লিঃ।
বেলা‘র পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন অ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং তাঁকে সহযোগিতা করেন অ্যাডভোকেট এস. হাসানুল বান্না।
আরও তথ্যের জন্য যোগাযোগ করুন-
এস. হাসানুল বান্না
অ্যাডভোকেট বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও আইনজীবী, বেলা
মোবাইল ০১৮৩৩০২৬২৬২