প্লাস্টিক দূষণ বর্তমান সময়ে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বল্প খরচ, সহজলভ্যতা ও ব্যবহারিক সুবিধার কারণে এর ব্যবহার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্লাস্টিক অপচনশীল বিধায় পরিবেশে দীর্ঘদিন (প্রায় ৪০০ থেকে ১০০০ বছর) টিকে থাকতে সক্ষম যা পরবর্তীতে মাইক্রোপ্লাস্টিকে রূপান্তরিত হয়ে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে। প্লাস্টিক বর্জ্য মাটি ও পানির স্বাভাবিক ভারসাম্যকে বিঘিœত করে এবং মাটির ছিদ্রপথ বন্ধ করে মাটির নিচে পানি ও বাতাস প্রবেশে বাধা প্রদান করে। ফলশ্রæতিতে মাটির গুণাগুণ নষ্ট হয়ে উর্বরতা হ্রাস পায় এবং ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়। একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বিশেষ করে খাবারের মোড়ক ও বোতল থেকে নির্গত বিষাক্ত রাসায়নিক মানুষের শরীরে প্রবেশ করে ক্যান্সার, কিডনি রোগ, হরমোনজনিত সমস্যা, বন্ধ্যাত্ব ইত্যাদি জটিল রোগের সৃষ্টি করে। মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণি খাদ্যচক্রে প্লাস্টিক গ্রহণ করছে যা পরোক্ষভাবে মানুষের খাদ্যেও প্রবেশ করছে। এছাড়াও প্লাস্টিক পুড়িয়ে ফেলা হলে পরিবেশে বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পায় এবং পরিবেশ দূষিত হয়। ইতোমধ্যে প্লাস্টিক দূষণ এবং প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশে^র শীর্ষ দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। দেশে উৎপাদিত মোট প্লাস্টিক বর্জ্যরে প্রায় অর্ধেকেরও বেশি একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক।
প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা অনুধাবন করে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০০২ সালে “পলিথিন শপিং ব্যাগ” নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও এ আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন অদ্যাবধি হয়নি। বর্তমান অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার ০১ অক্টোবর, ২০২৪ থেকে সুপারশপগুলোতে এবং ০১ নভেম্বর, ২০২৪ থেকে কাঁচাবাজারে পলিথিন ও পলিপ্রোপাইলিন শপিং ব্যাগ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ইতোপূর্বে ২০১০ সালে কতিপয় পণ্যের সরবরাহ ও বিতরণে কৃত্রিম মোড়কের ব্যবহারজনিত কারণে সৃষ্ট পরিবেশ দূষণ রোধকল্পে বাধ্যতামূলকভাবে পাটজাত মোড়ক ব্যবহার নিশ্চিতকরণে “পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন” এবং ২০১৩ সালে “পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার বিধিমালা” প্রণয়ন করা হয়েছে। ২০১৮ সালের সর্বশেষ সংশোধনীসহ বর্তমানে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহারের জন্য ১৯টি পণ্য নির্ধারণ করা হয়েছে যারমধ্যে রয়েছে- ধান, চাল, গম, ভূট্টা, সার, চিনি, মরিচ, হলুদ, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, ডাল, ধনিয়া, আলু, আটা, ময়দা, তুষ-খুদ-কুড়া এবং পোল্ট্রি ও ফিস ফিড।
আইনী বিধানসমূহের ব্যত্যয় ঘটিয়ে পলিথিন ব্যাগের অনিয়ন্ত্রিত উৎপাদন, বাজারজাত ও ব্যবহার যথেচ্ছভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হলে প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা থেকে পরিত্রাণ পেতে পলিথিন/প্লাস্টিক ব্যাগের উপর বিদ্যমান আইনী নিষেধাজ্ঞা কার্যকর ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার বন্ধে বেলা ও কয়েকটি সমমনা সংগঠন মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে একটি জনস্বার্থমূলক মামলা (নং ১৪৯৪১/২০১৯) দায়ের করে। মামলার প্রাথমিক শুনানী শেষে মহামান্য আদালত জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় দেশব্যাপী নিয়মিত বাজার পর্যবেক্ষণ, কারখানা বন্ধ এবং যন্ত্রপাতি জব্দকরণের মাধ্যমে পলিথিন/প্লাস্টিক ব্যাগের উপর বিদ্যমান আইনী নিষেধাজ্ঞার পূর্ণ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে বিবাদীগণকে নির্দেশ প্রদান করেন। সেইসাথে দেশের সকল হোটেল, মোটেল ও রেস্তোরায় একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার নিষিদ্ধ করাসহ সকল উপকূলীয় অঞ্চলে পলিথিন/প্লাস্টিকের ব্যাগ বহন, বিক্রয়, ব্যবহার, বিপণন নিষিদ্ধ করার নির্দেশও প্রদান করেন আদালত।
আইন ও আদালতের সুস্পষ্ট বাধ্যবাধকতা থাকা সত্তে¡ও বর্তমানে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল পলিথিন উৎপাদন ও বিপণন অব্যাহত রেখেছে। ফলশ্রæতিতে কোনভাবেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না এর যথেচ্ছ ব্যবহার। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপের অভাবে পলিথিনের বিকল্প পণ্য ব্যবহারে সফলতা আনতে সক্ষম হয়নি। পলিথিন ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পণ্যের ক্ষতি নিরসনের একমাত্র উপায় হলো এর ব্যবহার কমিয়ে বিকল্প পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহারে অভ্যস্ত হওয়া। এ প্রেক্ষাপটে টেকসই প্যাকেজিং বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সম্পদ পাটের ব্যবহার সম্প্রসারণ করা বর্তমান সময়ে দাবি।
এমতাবস্থায় বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি পরিবেশবান্ধব ও টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন, ২০১০ এবং পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার বিধিমালা, ২০১৩ এর যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে পলিথিন ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছে। একইসাথে পলিথিন শপিং ব্যাগ উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহণ বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার ইত্যাদি নিষিদ্ধ কার্যক্রমের সাথে জড়িতদের যথাযথ শাস্তির দাবি জানাচ্ছে। সেইসাথে উৎপাদক ও ভোক্তার সচেতনতা বৃদ্ধি, সমাজের সব শ্রেণি/পেশার মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বিকল্প পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা কার্যক্রম পরিচালনার অনুরোধ জানাচ্ছে।
আরও তথ্যের জন্য যোগাযোগ করুন-
এস. হাসানুল বান্না
এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট
ও আইনজীবী, বেলা।
মোবাইলঃ ০১৮৩৩০২৬২৬২