ঝিনাইদহ সরকারি শিশুপার্ক সংরক্ষণে বেলা’র আইনি সফলতার ইতিবৃত্ত
ঝিনাইদহ শিশুপার্ক
ঝিনাইদহ সরকারি শিশুপার্ক সংরক্ষণে বেলা’র আইনি সফলতার ইতিবৃত্ত
বাংলাদেশ পরিবেশআইনবিদ সমিতি (বেলা) পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পরিবেশগতউন্নয়ন ও প্রাকৃতিকসম্পদ সুরক্ষা, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীসংরক্ষণ ও এরনিরাপত্তাবিধানএবংপ্রাকৃতিকপরিবেশ-প্রতিবেশ সুরক্ষায় জনগণের পরিবেশগত অধিকার ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় পরিবেশগত জনস্বার্থ সুরক্ষায় ঝিনাইদহ সরকারি শিশুপার্কের শ্রেণি পরিবর্তন করে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত ভুক্তভোগী জনগণের অভিযোগের প্রেক্ষিতে বেলা ০৫ নভেম্বর ২০১৯ ইং তারিখে জনস্বার্থমূলক একটি মামলা দায়ের করে (মামলানং১২৪৪০/২০১৯)।
সম্প্রতি এই সরকারি শিশুপার্কটির শ্রেণি পরিবর্তন নাকরার দাবিতে বেলা’র আইনগত পদক্ষেপের প্রেক্ষিতে মহামান্য হাইকোর্ট পার্ক সংরক্ষণের পক্ষে একটি রুল এবং স্থগিতাদেশ দিয়েছে যা ঝিনাইদহ এলাকার পরিবেশ প্রেমী সচেতন মহলের পাশাপাশি আপামর জনগোষ্ঠীকে পরিবেশগত অধিকার সংরক্ষণে সাহসী এবং পরিবেশগত আইনের প্রতি আস্থাশীল করেতুলেছে যা বেলা’র আইনগত লড়াইয়ের একটি সফল দৃষ্টান্ত হিসেবে জনসাধারণের নিকট বিবেচিত।
ঝিনাইদহ শিশুপার্ক ও উদ্ভূত সমস্যার প্রেক্ষাপট
ঝিনাইদহ জেলার ঝিনাইদহ পৌরসভার পৌরসভা প্রশাসন কার্যালয়ের পাশে ১২৫ নং ঝিনাইদহ মৌজার ৭৮৪ নং দাগে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী ঝিনাইদহ সরকারি শিশুপার্ক। বৃটিশ শাসনামলে সৃষ্ট এই পার্কটি এলাকার শিশু-কিশোর-বয়োঃবৃদ্ধদের বিনোদনের একটি অন্যতম প্রধান জায়গা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ১৯৬১ সালে ঝিনাইদহ পৌরসভা গঠিত হয় এবং জেলাপ্রশাসন পৌরসভার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ‘টাউনকমিটি’নামে একটি অনির্বাচিত কমিটি গঠন করে সেই কমিটিকে পার্কটিকে সংরক্ষণের দায়িত্ব প্রদান করে। সেই থেকে এই কমিটি পার্কটির রক্ষণাবেক্ষন ও দেখাশুনা করে আসছিল। প্রসঙ্গত, এই পার্কে প্রায় তিনশত প্রজাতির দেশী-বিদেশী গাছ ছিল এবং দীর্ঘদিন থেকে এই পার্কেই সকল জাতীয় দিবসসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি পালিত হয়েআসছে। কিন্তু বিগত কয়েক মাস আগে এমন জনগুরুত্বপূর্ণ পার্কটির গুরুত্ব বিবেচনায়না এনে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ঝিনাইদহ পৌরসভা এবং ঝিনাইদহ জেলাপ্রশাসন এই পার্কটির শ্রেণি পরিবর্তন করে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন তৈরির অপচেষ্টা চালিয়ে আসছিল।
আইনি লড়াইলব্ধ অভিজ্ঞতা ও সমস্যাসমূহ
গত জুলাই ২০১৯ ইং তারিখে এই অনৈতিক কার্যক্রমের প্রেক্ষাপটে পার্কটি সংরক্ষণে স্থানীয় জনগোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নকর্মসূচি গ্রহণসহ ঝিনাইদহ জেলাপ্রশাসক, ঝিনাইদহ পৌর মেয়র এবং পরিবেশ অধিপ্তরের উপ-পরিচালক বরাবর পার্কটি সংরক্ষণের দাবিতে স্থানীয়জনগোষ্ঠীর গণস্বাক্ষর সম্বলিত চিঠি দিয়ে যখন কোন সুরাহা করেতে পারছিলেননা তখন ক্ষতিগ্রস্থ জনগোষ্ঠী প্রতিকার চেয়ে সেপ্টেম্বর ২০১৯ বেলা প্রধান কার্যালয় বরাবর তাদের অভিযোগ জানালে সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতে ০২ অক্টোবর ২০১৯ ইং বেলা, খুলনা বিভাগের প্রতিনিধি ঝিনাইদহ শিশুপার্কটি সরজমিনে পরিদর্শনকরে এবং আইনগত পদক্ষেপের নিমিত্তে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করে।
ঝিনাইদহ সরকারি শিশুপার্ক সরজমিন পরিদর্শনকালীন নি¤েœাক্ত বিষয়াবলী পরিলক্ষিত হয়-
- ঝিনাইদহ জেলার জেলাপ্রশাসক সরোজকুমারনাথ সরকারি শিশুপার্কের শ্রেণিপরিবর্তনের নেপথ্যে ভমিকা রাখছেন যিনি বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ পঙ্কজ দেবনাথের ছোটভাই। সুতরাং, একাধারে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাব খাটিয়ে তিনি এই অনৈতিক কাজকরছেন বলে ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীরপক্ষ থেকে অভিযোগ উঠেছে।
- ঝিনাইদহ পৌরসভার মেয়র সাইদুল করিমমিন্টু জনস্বার্থকে প্রত্যাখ্যানকরে ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের নিমিত্তে এই কাজকরছেন বলে ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীজানায়।
- পার্কটি ঝিনাইদহ-২ আসনের মধ্যে অবস্থিত যেই আসনের সংসদ সদস্য তাহজিব আলম সিদ্দিকী শুরু থেকেই ঝিনাইদহ শিশুপার্কটি অক্ষুন্ন রাখার পক্ষে থাকাসত্তে¡ ও সাংসদের মতামতকে অগ্রাহ্য করে ঝিনাইদহ জেলাপ্রশাসক ও তার দোসররা প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পার্কের শ্রেণি পরিবর্তন করে বাণিজ্যিক বহুতলভবন নির্মাণ করার অপচেষ্টা চালিয়েযাচ্ছেন।
মাঠ পরিদর্শন পূর্বকপ্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে পার্কটি সংরক্ষণে বেলা গত ১৩ অক্টোবর ২০১৯ইং তারিখে সচিব, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, সচিব, স্থানীয় সরকার বিভাগ, মহাপরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলাপ্রশাসক, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, ঝিনাইদহ, পুলিশ সুপার, ঝিনাইদহ, উপ-পরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর, যশোর, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ঝিনাইদহ উপজেলা, সহকারী কমিশনার (ভূমি), ঝিনাইদহ, চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদ, ঝিনাইদহ, মেয়র, ঝিনাইদহ পৌরসভা, ঝিনাইদহ, অফিসার ইন চার্জ, ঝিনাইদহ পুলিশ স্টেশন, ঝিনাইদহসহ মোট এগারো (১১) জন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিবাদী করে একটি লিগ্যাল নোটিশ প্রেরণ করে।
লিগ্যাল নোটিশের মাধ্যমে পার্কটি শ্রেণি অপরিবর্তিত রেখে পার্কটিকে‘পার্ক’হিসেবে যথাযথ ভাবে সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দাবি জানানো হয়। একইসাথে, উল্লেখিতপার্কে পৌরসভা কর্তৃক গৃহীত বহুতলভবন নির্মাণ সংক্রান্ত সকলকার্যক্রম অনতিবিলম্বে বন্ধের এবং ইতোমধ্যে পার্কের যতটুকু শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়েছে তা পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার দাবি জানানো হয়। সেইসাথে পার্কে বিদ্যমান ইতোমধ্যে নিধনকৃত বৃক্ষের বিপরীতে যে পরিমাণ বৃক্ষরোপণ প্রয়োজন ও সমীচীন তা নিরূপণ পূর্বক দেশীয় প্রজাতির বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে পার্কের সবুজ প্রকৃতি ফিরিয়ে আনার জোর দাবি জানানো হয়। লিগ্যাল নোটিশের মাধ্যমে ৭ (সাত) দিনের মধ্যে বেলা প্রধান কার্যালয় বরাবর পার্কটি সংরক্ষণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে অবহিতকরণ পূর্বক, ব্যতি ক্রমে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়।
নোটিশ প্রেরণের ৭ (সাত) দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জবাব নাআসায় বেলা গত ৫ নভেম্বর ২০১৯ পার্কটি সংরক্ষণের দাবিতে হাইকোর্টে পিটিশন দাখিল করে এবং প্রাথমিক শুনানী শেষে গত ১১ নভেম্বর ২০১৯ বিচারপতি জনাব মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি জনাব খন্দকার দলিরিুজ্জামান এর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ উক্ত জনস্বার্থ মূলক মামলায় (মামলা নং- ১২৪৪০/২০১৯) মহামান্য হাইকোর্ট পার্ক সংরক্ষণের পক্ষে রুল ও নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। রুল ও নিষেধাজ্ঞায় মহামান্য হাইকোর্ট ঝিনাইদহ জেলার ঝিনাইদহ পৌর সভার অন্তর্গত এলাকার একমাত্র সরকারি শিশুপার্কের শ্রেণি পরিবর্তন করে পার্কের মাঠে পৌরসভা কর্তৃক গৃহীত বহুতল ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত সকল কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেন। পাশাপাশি ৬নং বিবাদী মেয়র, ঝিনাইদহ পৌরসভাকে পাবলিক পার্কের মাঠের স্থানে নির্মাণ কাজকে কেন অন্যান্য বিবাদীগণের ব্যর্থতা হিসেবে গণ্য করা হবেনা সেই মর্মে রুল জারি করেন। একই সাথে তাৎক্ষণিক ভাবে এ নির্মাণ কাজ বন্ধ করে সরকারি শিশুপার্কের শ্রেণি অপরিবর্তিত রেখে‘পার্ক’হিসেবে পুনরূদ্ধার, সংরক্ষণ ও যথাযথ রক্ষণা বেক্ষণের আদেশ প্রদান করেন।
মামলার সফলতা ও প্রভাব
- ঝিনাইদহ শিশুপার্ক সংরক্ষণে সকল অংশীজনদের পাশাপাশি ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠী, পার্ক সংরক্ষণের পক্ষে আন্দোলনকারী জনগোষ্ঠী, আইন ও বিচার বিভাগ, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট সকলের পার্ক সংরক্ষণে ইতিবাচক মানসিকতা এবং সমন্বিত উদ্যোগ পার্কটি সংরক্ষণের পক্ষে রায় পেতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।
- কোন প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক শক্তিই আইনের উর্ধ্বে নয়, সেটা বেলা’র এই আইনগত লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হয়েছে।
- বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)’র পিটিশনের প্রেক্ষিতে মহামান্য হাইকোর্টের দেয়া স্থগিতাদেশ ঝিনাইদহ এলাকার মানুষদের আইনের প্রতি আরো বেশি শ্রদ্ধাশীল করেছে এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বেলা’র প্রতি আস্থা আরো বহু গুন বাড়িয়ে দিয়েছে।
- সর্বোপরি পরিবেশ সংরক্ষণ এবং পরিবেশগত ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করণ পূর্বক পরিবেশ আইনকে মাধ্যম করে বেলা’র এই উদ্যোগ বেলার সার্বিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণে সহায়ক হয়েছে।