বড়াল নদী রক্ষায় বেলা’র আইনগত পদক্ষেপ ও সফলতা
বড়াল নদী রক্ষায় বেলা
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সুস্থ্য পরিবেশ গড়ার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই কাজ করে আসছে। ন্যায্য, ন্যায়সঙ্গত এবং লিঙ্গ সমতার ভিত্তিতে কমিউনিটির ক্ষমতায়ন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশগত অধিকার সুরক্ষা করাই হলো বেলা’র মূল লক্ষ্য। পরিবেশগত অধিকার ও অধিকার বিষয়ক সচেতনতা গড়ে তোলার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে প্রচারাভিযান, সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং পলিসি এডভোকেসীর মাধ্যমে পরিবেশগত শাসন ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে বেলা কাজ করে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক সম্পদে ও পরিবেশগত নীতি নির্ধারণে স্বচ্ছ, দায়বদ্ধ ও জন অংশগ্রহণ মূলক কর্মসূচিকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি পরিবেশগত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বেলা ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের পক্ষে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। বড়াল নদী রক্ষার দাবিতে জনস্বার্থমূলক মামলা বেলা’র এই ধারাবাহিক কর্মসূচিরই একটি অংশ।
বড়াল নদী
বাংলাদেশের প্রধান দু’টি নদী পদ্মা ও যমুনা নদীর মধ্যকার সংযোগকারী নদী হলো বড়াল নদী যা মৎস্য ও কৃষি ভান্ডারখ্যাত উত্তরাঞ্চলের সর্ববৃহৎ জলাভূমি চলনবিলে পানি সরবরাহকারী প্রধান নদী। উত্তরাঞ্চলের চারটি জেলা রাজশাহী, নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জের বুক চিরে নদীটি প্রবাহিত হয়েছে। নদীটি রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায় পদ্মার শাখা নদী হিসাবে উৎপত্তি হয়ে বড়াল বাঘা, বাগাতিপাড়া, লালপুর, বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, চাটমোহর, ভাঙ্গুরা, ফরিদপুর, সাথিয়া উপজেলা অতিক্রম করে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলায় করতোয়ার সাথে মিশে হুরাসাগর হয়ে যমুনায় গিয়ে পতিত হয়েছে। উৎস থেকে মোহনায় পতিত হওয়া পর্যন্ত বড়ালের যেমন কয়েকটি শাখা ও উপশাখার সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি অনেক নদীও বড়ালে এসে মিশেছে। চারঘাট থেকে বাঘাবাড়ি পর্যন্ত বড়ালের দৈর্ঘ্য প্রায় ২২০ কিলোমিটার।
সমস্যা
উত্তরাঞ্চলের মৎস্যভান্ডারখ্যাত চলনবিলে পানি সরবরাহের অন্যতম উৎস হলো বড়াল নদী। বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের নামে পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), রোডস এন্ড হাইওয়ে ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান বড়াল নদীর উপর বিভিন্ন সময়ে ব্রিজ, ¯øুইসগেট/রেগুলেটর, কালভার্ট ইত্যাদি স্থাপনা নির্মাণ করেছে। অন্যদিকে নদী দখল করে বাড়ি-ঘর নির্মাণের পাশাপাশি অনেকেই নদীকে দখল করে চাষাবাদের জমি হিসেবে ব্যবহার করে আসছিলেন। এছাড়াও নদীর উপর আড়াআড়ি বাঁধ (ক্রস ড্যাম) দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করা সহ নদীর উপর পাবনার চাটমোহর উপজেলার বোঁথর বাঁধ, নতুনবাজার বাঁধ, রামনগর বাঁধ এবং চাটমোহর-ভাঙুড়া উপজেলার মথুরা-দোহারপাড়া বাঁধ নির্মাণ উল্লেখযোগ্য। এভাবে বড়ালের উপর বাঁধ দিয়ে প্রভাবশালীরা নিজেদের স্বার্থে এই নদীকে পুকুর হিসেবে ব্যবহার করে মাছের ব্যবসা করে আসছিল।
এসব অবকাঠামো নির্মাণের ফলে নদী সংকুচিত হয়ে নদীর উৎস্যমুখ বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে। এতে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ নষ্ট হয়ে গেছে। নদীতে মাছ নেই বললেই চলে। নদীর পানিনির্ভর সেচ ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়েছে এবং ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়েছে। বড়াল শুকিয়ে যাওয়ায় নদীবাহিত পলি মাটি না পাওয়ার কারণে বড়াল অববাহিকার কৃষিজমি যেমন উর্বরতা হারাচ্ছে তেমনি সেচের পানির অভাবে কমে গেছে কৃষি উৎপাদন। জমির উর্বরতা কমে যাওয়ার কারণে বেড়ে গেছে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার। নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে বড়াল কেন্দ্রীক জীবন-জীবিকা এবং পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
বড়াল নদী রক্ষায় গড়ে ওঠা সামাজিক আন্দোলনের সাথে বেলা’র অংশগ্রহণ
বিগত ২০০৮ সাল থেকে বড়াল নদীর বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের দাবিতে ‘বড়াল রক্ষা আন্দোলন’ নামের একটি সামাজিক সংগঠন গড়ে ওঠে। এই সংগঠন ধারাবাহিকভাবে জনসচেতনতামূলক সভা, সেমিনার, মানববন্ধন ইত্যাদি কর্মসুচি পালনের মধ্যে দিয়ে বড়াল রক্ষায় আন্দোলন গড়ে তোলে ও নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বরাবর আবেদন করে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, ভূমি-মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, স্থানীয় সংসদ সদস্য, মৎস্য অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসক, উপজেলা (বন, কৃষি, পশুসম্পদ, মৎস্য) কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এসব আবেদন করা হয়েছে। এমনকি আন্দোলনকারীরা বড়ালের উৎস হতে পতিতমুখ পর্যন্ত ২২০ কিলোমিটারব্যাপী একটি মানববন্ধন করে। বড়াল রক্ষা আন্দোলনের দাবির সাথে একাত্ম হয়ে বেলা কমিউনিটি কনসালটেশন, আলোচনা সভা, গণশুনানীসহ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে।
বেলা’র আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ
সামাজিক আন্দোলনকারীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে বড়াল নদীর সীমানা নির্ধারণ, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করা, দখল অবমুক্ত করা, নদীর উপর অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত স্থাপনা অপসারণসহ নদী বিরোধী সকল কার্যক্রম বন্ধের দাবিতে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ২০১৪ সালে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে জনস্বার্থমূলক একটি মামলা দায়ের করে (মামলা নং ১৫৬৭/২০১৪)।
প্রাথমিক শুনানি শেষে ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ তারিখে বিচারপতি জনাব মির্জা হোসেন হায়দার এবং বিচারপতি জনাব মুহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকার-এর সমন্বয়ে গঠিত মহামান্য সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একটি ডিভিশন বেঞ্চ রাজশাহী, নাটোর, পাবনা এবং সিরাজগঞ্জের উপর দিয়ে প্রবাহিত বড়াল নদীর পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করতে সিএস ম্যাপ এবং প্রাথমিক প্রবাহ অনুযায়ী নদীটির সীমানা নির্ধারণ করে নদীর পানি প্রবাহ বিঘœকারী সকল অবকাঠামো অপসারণ এবং ইজারাসহ নদী বিরোধী সকল কার্যক্রম বন্ধের জন্য কেন নির্দেশ দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে বিবাদীদের প্রতি রুল নিশি জারী করেন।
একইসাথে ৭ (সাত ) সদস্য বিশিষ্ট নদী বিষয়ক টাস্কফোর্স কমিটির সুপারিশমালা বাস্তবায়নের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন, কামারদহ (মির্জা মোহাম্মদ খাল) থেকে কাচুয়াটি পর্যন্ত ক্যানেল প্রশস্তকরণ ও গলাকাটা ব্রীজটি প্রশস্তকরণের মাধ্যমে চারঘাট থেকে হুড়াসাগর পর্যন্ত বড়াল নদীর প্রবাহ বৃদ্ধিকরণ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দুই মাসের মধ্যে আদালতে জমা দেয়ার জন্য বিবাদীগণকে নির্দেশ প্রদান করেন।
বেলা’র দায়ের করা রিটের বিবাদীরা হলেন ভূমি, মৎস্য ও পশুসম্পদ, পরিবেশ ও বন, পানি সম্পদ এবং স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়’র সচিব; মহাপরিচালক পরিবেশ অধিদপ্তর; মহাপরিচালক বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড; রাজশাহী, পাবানা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসক; জেলা মৎস্য কর্মকর্তা, নূরপুর, পাবনা; পরিচালক পরিবেশ অধিদপ্তর, রাজশাহী বিভাগ, বগুড়া; উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা, চাটমোহর, পাবনা।
সফলতা
আদালতের আদেশ বাস্তবায়নের অংশ হিসাবে পাবনার চাটমোহর উপজেলার বোঁথর বাঁধ, নতুনবাজার বাঁধ, রামনগর বাঁধ এবং চাটমোহর-ভাঙুড়া উপজেলার মথুরা-দোহারপাড়া বাঁধ অপসারণ করা হয়েছে। চাটমোহর উপজেলার বোঁথর ঘাটে মাটির বাঁধ অপসারণ করে ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে এবং রামনগর ঘাটে বেইলি ব্রিজ নির্মাণের কাজ চলছে। রাজশাহী জেলার চারঘাটে বড়ালের উৎসমুখে পদ্মা এবং বড়ালের মাঝখানে বালুর চর পড়ে পদ্মা ও বড়ালের সংযোগ যেখানে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল সেখানে ১৮০০ মিটার খনন করা হয়েছে। বর্তমানে চারঘাটে পদ্মা-বড়ালের সংযোগ আবার স্থাপিত হয়েছে এবং দীর্ঘ ৩০ বছর পর ২০১৮ সালে চারঘাট ¯øুইসগেট খুলে দেওয়া হয়েছে।
আদালতের আদেশ বাস্তবায়নের অংশ হিসাবে বড়াল নদী পূনরুদ্ধার বা পূনরুজ্জীবিত করতে বড়ালের প্রবাহ নিশ্চিতকরণ ও এই এলাকার পানির উৎসগুলো রক্ষায় কী কী করা যেতে পারে সে বিষয় নিয়ে কাজ করতে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বড়াল নদী এবং তার অববাহিকা অঞ্চলে একটি সার্ভে পরিচালিত করতে ইন্সটিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডাবিøউএম) নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ প্রদান করেছে। আইডাবিøউএম ইতিমধ্যে ‘ডিটেইল্ড ফিজিবিলিটি স্টাডি উইথ ইএসআইএ ফর রেস্টোরেশন অব ওয়াটার রিসোর্সেস এরাউন্ড বড়াল রিভার বেসিন’ শীর্ষক একটি সার্ভে পরিচালনা করেছে। উক্ত সার্ভের অংশ হিসাবে আইডাবিøউএম’র আহবানে পানি উন্নয়ন বোর্ড, আইডাবিøউএম’র সাথে বেলা এবং বড়াল রক্ষা আন্দোলন বাঘাবাড়ি, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর, বড়াইগ্রাম, বাগাতিপাড়া, লালপুর ও চারঘাট এলাকায় বড়াল নদী পরিদর্শন করে। এতে বাঘাবাড়ি থেকে চারঘাট পর্যন্ত বড়ালের প্রবাহ বিঘœকারী সকল স্থাপনা, নদীর সাথে সংযুক্ত খালসমূহ, নদী দখল, দূষণ ইত্যাদি বিষয় সার্ভে টিমকে পরিদর্শন করানো হয়।
শেষ কথা
উন্নয়ন অবশ্যই প্রয়োজন, তবে সে উন্নয়ন টেকসই হতে হবে। পরিবেশের ক্ষতি করে এবং জনস্বার্থ বিরোধী উন্নয়ন কখনো কাম্য হতে পারে না। তাই বড়াল, চলনবিলসহ যেকোনো এলাকায় উন্নয়ন কর্মকাÐ পরিচালনার আগে তাতে পরিবেশ সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি মানা হচ্ছে কী না, তাতে জনসম্পৃক্ততা আছে কী না এবং তা জনগণের জন্য প্রকৃত সুফল বয়ে আনবে কী না সেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এছাড়া কোনো প্রকল্প গ্রহণের আগে এলাকাবাসীর জনমত যাচাইও নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বিলগুলোর মধ্যে অন্যতম চলনবিলের প্রাণ বড়াল নদী। এ নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করে সারাবছর চালু রাখার দাবি এ অঞ্চলের মানুষের প্রাণের দাবি। চলনবিল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ধরণের অবদান রেখে আসছে। এই বিলে পানির প্রধান উৎস্য হলো বড়াল নদী। বড়াল এবং চলনবিলের সাথে অসংখ্য মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত। অপরিকল্পিত বিভিন্ন কার্যক্রমের কারণে বড়াল ও চলনবিলের অস্তিত্ব আজ হুমকির সম্মুখীন। সকল বাধা অপসারণ করে বড়ালসহ অন্যান্য নদী ও খালের উন্নয়ন ঘটাতে পারলে তার ইতিবাচক প্রভাব জাতীয় অর্থনীতিতে পড়বে বলে বড়াল অববাহিকার মানুষ মনে করে।
বর্তমানে মামলাটি রায়ের অপেক্ষায় রয়েছে। বড়ালপাড়ের মানুষের সাথে বেলা বিশ্বাস করে যে, আগামী দিনে আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রশাসন দ্রততম সময়ের মধ্যে রায় বাস্তবায়ন করবে।