বেলার আইনী পদক্ষেপের মাধ্যমে মির্জাপুরে অবৈধ কয়লা ও সীসা উৎপাদন বন্ধ
কয়লা উৎপাদন ও ব্যাটারী গলিয়ে সিসা তৈরি বন্ধের সফল কাহিনী
টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর উপজেলার আজগানা, বাশতৈল, তরফপুর ও গোড়াই ইউনিয়নের খাটিয়ারঘাট, খালপাড়, তেলিনা, কুমড়ীপাড়া, নয়াপাড়া, পেকুয়া, মোতারচালা, গায়রাবেতিল ও বংশীনগর সহ বিভিন্ন এলাকায় কিছু অসাধু চক্র সরকারি বনের ভিতর এবং বন সংলগ্ন পার্শ্ববর্তী এলাকায় অবৈধভাবে কয়লা তৈরির কারখানা (চুল্লি) নির্মাণ করে কাঠ পুড়িয়ে সেখানে কয়লা উৎপাদন করে আসছিল। পাশাপাশি পুরাতন ব্যাটারী গলিয়ে সীসাও উৎপাদন করা হতো। কয়লা ও সীসার ধোয়ার কারণে সারাক্ষণ এ সকল এলাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে থাকতো। একদিকে মির্জাপুরের সনাতনী ইটভাটার কালো ধোয়া অপরদিকে সীসা তৈরি ও কয়লা উৎপাদনের কালো ধোয়া এলাকাগুলোকে একটি গ্যাস চেম্বারে পরিণত করে ফেলেছিল। বিষাক্ত ধোয়ার কারণে এ সকল এলাকায় স্থানীয় লোকজনের বসবাস করা দূরুহ হয়ে পড়েছিল। কৃষি উৎপাদন, জনস্বাস্থ্য, ফসলী জমি এমনকি ফলের গাছগুলোতেও এর বিরূপ প্রভাব ছিল মারাত্বক যা এলাকার পরিবেশগত ভারসাম্যকে তীব্রভাবে বিপদাপন্ন করে তুলেছিল।
ভুক্তভোগী স্থানীয় জনগন প্রশাসনের কাছে পরিবেশবিরূপ এ সকল অবৈধ কার্যক্রম বন্ধের জোর দাবী জানিয়েও ফলপ্রসু কোন সমাধান আনতে পারেনি। পরিবেশবিরূপ এ সকল অবৈধ কার্যক্রম বিভিন্ন সময় স্থানীয় এবং জাতীয় পত্রিকায় খবর আকারে আসা ব্যতীত অন্য কোন দৃষ্টিগোচর কাজ পরিলক্ষিত হয় নি। এমনকি তরফপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জনাব সাঈদ আনোয়ার কর্তৃক বেআইনীভাবে ট্রেড লাইসেন্স প্রদানও ছিল বন আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থি।
বন আইনে বনবিরূপ কোন কাজ করা যাবে না বলে যেখানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে সেখানে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের খুব কাছাকাছি এলাকায় এইরূপ বনবিরূপ কার্যকলাপ চলে আসছিল দীর্ঘদিন ধরে। প্রভাবশালী জনগণ কর্তৃক এ সকল কাজ পরিচালিত হচ্ছিল বলে স্থানীয় জনগোষ্ঠী ভয়ে মুখ খোলার সাহস পর্যন্ত পাচ্ছিল না। কিন্তু পরবর্তীতে গোড়াই ইউনিয়নের রহিমপুরে ব্যাটারীর সীসা গালানোর কাজ শুরু করলে এলাকায় বসবাসরত স্থানীয় জনগন ঐক্যবদ্ধভাবে ব্যাটারী পোড়ানোর মালিক জয়নাল মিয়াকে সেখান থেকে উঠিয়ে দেন। কিন্তু তাতেও কোন লাভ হয় নি, উনি অন্যত্র তার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকেন।
রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দের ছত্রছায়ায় পরিচালিত এ সকল সীসা ও কয়লা কারখানার অবৈধ কার্যক্রম স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশের সহযোগিতায় বেশ কয়েকবার ভেঙ্গে ও বন্ধ করে দিলেও তা কখনোই স্থায়ী রূপ পায়নি। সাংবাদিক কর্তৃক ও পত্র-পত্রিকার বিভিন্ন সংবাদের ভিত্তিতে বিষয়টি বেলা’র গোচরে আসলে বেলা কয়লা ও সীসা উৎপাদনকারী মালিকদের সঙ্গে পারস্পরিক আলোচনা ও বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ ও পরিবেশগত ভারসাম্যের বিষয়টি মালিক পক্ষকে বুঝালে মালিক পক্ষ বেলা প্রতিনিধিকে আশ্বস্ত করেন যে, খুব দ্রæতই তারা এই কার্যক্রম বন্ধ করে দিবেন।
পরবর্তীতে ১৮ অক্টোবর ২০১৮ সালে এনজিও সমন্বয় সভায় বেলা প্রতিনিধি মির্জাপুর উপজেলার তরফপুর, আজগানা, গোড়াই ও বাঁশতৈল ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি বন এলাকায় বনের গাছ কেটে অবৈধভাবে কয়লা উৎপাদন, পুরাতন ব্যাটারী গালিয়ে সীসা তৈরির মাধ্যমে বায়ু দূষণ, কাঠ পোড়ানোর মাধ্যমে বন উজারীকরণ, কাঠ পোড়ানো ও সীসার ধোঁয়ার মাধ্যমে এলাকার জনস্বাস্থ্য, কৃষি উৎপাদন, ফলমূল উৎপাদন, ফসলী জমির বিনাশসহ পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্টের বিষয় এবং এ সকল অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষন করে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন বেলা প্রতিনিধিকে সরেজমিনে পর্যবেক্ষন করে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন জেলা প্রশাসক টাঙ্গাইল বরাবর প্রদান করার অনুরোধ জানালে উক্ত এলাকাসমূহের অবৈধ কার্যক্রমের ছবিসহ একটি প্রতিবেদন ৮ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে জেলা প্রশাসক, টাঙ্গাইল বরাবর প্রেরণ করা হয়। উক্ত প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে ৬০টি কয়লা ও সীসা তৈরির কারখানা স্থায়ীভাবে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেন উপজেলা প্রশাসন ও ভ্রাম্যমান আদালত।
প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষায় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ ও পরিবেশগত ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় বেলা’র সাহসী ও যুগোপযোগী এই পদক্ষেপের মাধ্যমে মির্জাপুরে অবৈধ কয়লা ও সীসা উৎপাদন বন্ধ করা সম্ভব হয়।
কেস ষ্টাডি
সাদামাটির অবৈধ উত্তোলন বন্ধের মাধ্যমে পরিবেশগত ভারসাম্য নিশ্চিতকরণ
নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার ১নং কুল্লাগরা ইউনিয়নের মাইজপাড়া, আড়াপাড়া, পাঁচকাহনিয়া মৌজার সাদামাটি/চিনামাটির পাহাড়বেষ্টিত ৮-১০টি গ্রামের প্রায় সর্বত্রই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সাদামাটি। অনিয়ন্ত্রিত ও নিয়মবহির্ভূতভাবে সাদামাটি উত্তোলনের ফলে এ সকল পাহাড় ও টিলার নিচে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন রংয়ের ছোট বড় জলাশয়। পাহাড়ী টিলার উপর গারো, হাজংদের বসবাস এবং সমতলে বাস করে স্থানীয় বাঙ্গালীরা। এক সময় পাহাড় ও টিলায় দেশি প্রজাতির গাছ ও লতাগুল্মের উপস্থিতি সহ জীববৈচিত্র্যময় এই সাদামাটির পাহাড়ে পর্যটকদের উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যণীয়।
সিরামিক সামগ্রী তৈরির প্রধান কাঁচামাল এই সাদামাটি। বিভিন্ন সিরামিক কোম্পানী খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো থেকে ডিও নিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালী হিসেবে চিহ্নিত মধ্যস্বত্বভোগীদের পাহাড় ও টিলা কাটার জন্য স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয় যারা ৮-১০ গ্রামের পাহাড় ও টিলা থেকে সাদামাটি বিধিবহির্ভূতভাবে কেটে আসছিল। ভারত থেকে নেমে আসা ৬-৭টি ঝর্ণা/ছড়ার প্রবাহ বন্ধ করে উত্তোলিত সাদা মাটি ফেলে জগৎপুড়া, বারইপাড়া, ছনগড়া, গাইমারা ও খুজিউড়া সহ বিভিন্ন এলাকায় সংরক্ষণের ফলে একটি কৃত্রিম জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ফলে প্রায় ৪০০ একর আবাদি ভূমি সারা বছর পানির নিচে থাকতো। একদিকে পাহাড় থেকে মাটিকাটার ফলে ধস নামার ভয়ে গারো, হাজংরা সর্বদা উচ্ছেদ আতংকে থাকতো অপরদিকে সমতলে বসবাসকারী বাঙ্গালী যেখানে সেখানে সাদামাটি স্তুপ করে রাখায় বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছিল উক্ত এলাকাসমূহ।
কোম্পানী ও মধ্যস্বত্ত¡ভোগীদের এইরূপ কার্যকলাপে ক্ষতিগ্রস্থ জনগোষ্ঠী এক পর্যায়ে সোচ্চার হয়ে উঠলে মতিলাল হাজংয়ের নেতৃত্বে পিযুষ চাম্বুগং, যোসেফ দাওয়া, বিশ্বজিৎ হাজং, কামাল হোসেন, হোসেন আলী সহ অনেক গ্রামবাসী মানববন্ধন, স্বারকলিপি প্রদানের মাধ্যমে প্রতিবাদ করেও কোন ফল পাচ্ছিল না। ভুক্তভোগী স্থানীয় জনগোষ্ঠী ২০১৪ সালে বেলা’র কাছে সাদামাটির অনিয়ন্ত্রিত উত্তোলন বন্ধে ন্যায়বিচার প্রাপ্তির লক্ষ্যে আবেদন করে।
একদিকে ক্ষতিগ্রস্থ জনপদের সংখ্যা দিন দিন যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছিল অপরদিকে সাদামাটির কুয়ারীতে কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকের জীবনদান ও জীবনদানের বিপরীতে কোনরূপ আর্থিক ক্ষতিপূরণ না পাওয়া একটি নিত্য-নৈমত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পুরুষের দৈনিক মজুরীর চেয়ে নারী শ্রমিকের মজুরী স্বাভাবিকভাবেই ছিল উল্লেখযোগ্য হারে কম। পাশাপাশি স্থানীয় এজেন্টদের কারণে এ সকল গ্রামবাসীর অসহায় দিনাতিপাত ছিল একটি স্বাভাবিক দৃশ্য। বেলা’র পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষনে লক্ষ্যিত হয় আহত শ্রমিকদের চিকিৎসার জন্য নেই কোন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বিশেষ করে নারীদের চিকিৎসার জন্য বিশেষ কোন ব্যবস্থা নেই। পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য সাদামাটি উত্তোলনের কারণে নষ্ট হয়ে গেছে। প্রভাবশালী সাদামাটি উত্তোলনকারীদের কারণে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল।
এহেন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বেলা বিক্ষুব্ধ ক্ষতিগ্রস্থদের পক্ষে জনস্বার্থে উচ্চ আদালতে একটি মামলা দায়ের করে (মামলা নং ১১৩৭৩/২০১৫)। রীট পিটিশনে বলা হয় বিভিন্ন কোম্পানী পরিবেশগত ছাড়পত্র (ইসিসি) এবং পরিবেশ ব্যবস্থাপনা প্ল্যান (ইএমপি) না থাকা সত্তে¡ও অনিয়ন্ত্রিত ও বিধি বহির্ভূতভাবে সাদামাটি উত্তোলন করছিল। বেলা’র মামলার প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত রুল জারি করে কেন সাদামাটি উত্তোলন অবৈধ ও বেআইনী ঘোষণা করা হবে না। উচ্চ আদালতের সর্বশেষ নির্দেশানুযায়ী বর্তমানে সাদামাটি উত্তোলন বন্ধ হয়ে গেছে।
লক্ষ্যণীয়, যখন সাদামাটি উত্তোলন করা হতো তখন এ সকল এলাকার রাস্তাঘাট ভাল ছিল না কিন্তু বর্তমানে পাকা রাস্তা নির্মিত হওয়াতে সাদামাটির পাহাড় দেখতে পর্যটকদের আর্কষণ বেড়েছে। উল্লেখ্য যখন কোম্পানীর এজেন্টদের আধিপত্যে সাদামাটির বস্তা ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হতো তখন আন্দোলনরত জনগণ জাতীয় সম্পদ রক্ষা ও প্রতিরোধ কমিটি গঠন করে। সেই সময় দূর্গাপুর উপজেলার নির্বাহী অফিসার যেখান দিয়ে ট্রাক সাদামাটি বোঝাই করে যাবে সেখানে একটি চেকপোষ্ট স্থাপন করে। সেই চেকপোষ্টে একেক সময় এক তহশিলদার বসে ট্রাক চেক এবং ডিও পরীক্ষা করতো। সেখানেও তহশিলদার সমস্যার সৃষ্টি করতো বলে এলাকার লোকজন চেক পোষ্টে তদারকি করতো। ফলস্বরূপ, বর্তমানে সাদামাটির পাহাড় ও টিলায় জীববৈচিত্র্য আবারও ফিরে আসছে।
পরিবেশগত ছাড়পত্র (ইসিসি) ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা (ইএমপি) না থাকায় পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫, পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭, খনিজ ও খনিজসম্পদ (নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন) আইন ২০১২, বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩, ভূমি ব্যবস্থাপনা আইন ১৯৯০ এর পরিপন্থি হওয়ায় বেলা উচ্চ আদালতের দৃষ্টি আকর্ষন করে সাদামাটি উত্তোলন বন্ধ করে। পাহাড়ী টিলায় বসবাসকারী ছমেলা খাতুন, কামাল হোসেন সহ উচ্ছেদকৃত সকল স্থানীয় ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠী যারা নিজ বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল তারা আবার তাদের নিজ বাসভূমে ফিরে এসেছে। সাদামাটি উত্তোলন বন্ধের মাধ্যমে পরিবেশগত ভারসাম্য সহ প্রাকৃতিক সম্পদে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিকরণের এই সফলতা এসেছে বেলা’র আইনগত পদক্ষেপের হাত ধরে।