দখলমুক্ত বরগুনার ঐতিহ্যবাহী ভাড়ানী খাল, জনমনে স্বস্তি
খালের ভৌগোলিক অবস্থান ও আর্থ-সামাজিক গুরুত্ব
বুড়িশ্বর (পায়রা), বিষখালী ও হরিণঘাটা নদী নদী বেষ্টিত উপকূলীয় জেলা বরগুনা’র সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য শাখানদী ও খালের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী অন্যতম একটি খাল হচ্ছে ভারানী খাল। ৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ খালটির অবস্থান জে এল ৩০ নং মৌজার এস.এ ১ নং খতিয়ানের ৭৮৯ ও ২১১৩ নং দাগে। পায়রা ও খাকদোন নদীর মধ্যে সংযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে যোগাযোগে সহজলভ্যতা সৃষ্টি এবং এই খালের মাধ্যমে খুব সহজেই এক নদী হতে অন্য নদীতে বের হয়ে যাওয়া যেত বলে খালটি ভাড়ানী খাল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এছাড়া, স্থান ও মৌজা ভেদে খালটির বিভিন্ন নামকরণ লক্ষ্য করা যায় যেমন- বরগুনা পৌরসভার অন্তর্গত জেএল ৩০ নং বরগুনা মৌজার ১ নং সিটে বরগুনার খাল, ৩ নং সিটে ভাড়া নিখাল, জেএল ২৭ নং কড়ইতলা মাইঠা মৌজায় কড়ই তলাখাল, ৬ নং বুড়ির চর ইউনিয়নের লবনগোলা মৌজায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার জুড়ে কয়েকটি গ্রামের উপর দিয়ে প্রবাহিত অংশটি স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে যথাক্রমে লবন গোলা, বাঁশবুনিয়া, ও গোল বনিয়ার খাল নামে পরিচিত।
ভাড়ানী খালটি বরগুনা জেলা শহরের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ নদী পায়রা ও খাকদোনের মধ্যে সংযোগ সৃষ্টি করার কারণে খালটির পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ও দক্ষিণাঞ্চলে বসবাসকারী জনগণের কাছে এর গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে বরগুনা জেলা শহরের সাথে পার্শ্ববর্তী তালতলী উপজেলা সহ অন্যান্য উপজেলা গুলোর ব্যবসা-বানিজ্য এবং বরগুনা সদর উপজেলার অন্তর্গত ৬ নং বুড়ির চর ইউনিয়নের বড়লবন গোলা, গোল বুনিয়া, মানিক খালী ও বরগুনা সদর ইউনিয়নের বাঁশবুনিয়া, কালিরতবক সহ এ খালের পূর্ব-পশ্চিম পাড়ের আরও অনেক গ্রামের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ও হাজার হাজার মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনায় পণ্য পরিবহনের সহজমাধ্যম হিসেবে খালটি বছরের পর বছরধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।
উদ্ভূত সমস্যা
অবৈধ দখল-দূষণের পাশাপাশি ক্রম বর্ধমান নাব্যতা সংকট খালটির স্বাভাবিক পানি প্রবাহকে ব্যহত করে, যার ফলে সৃষ্টিহয় যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রতিকূল পরিবেশ যা বরগুনা জেলার ব্যবসা-বাণিজ্যসহ স্থানীয় জনগণের যাপিত জীবন ও আর্থ-সামাজিক কর্মকান্ডকেও নানাভাবে ব্যহত করে। স্থানীয় জনগণের ভাষ্য অনুযায়ী, কয়েক বছর আগেও যখন খালটিতে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ বজায় ছিল তখন এ খাল দিয়ে ছোট ছোট লঞ্চ, মাল বোঝাই কার্গো, ট্রলার সহ অন্যান্য বাহারি নৌকা চলাচল করতো। স্থানীয় জেলেরা বিভিন্ন নদীতে গিয়ে মাছ ধরা এবং মাছ ধরে তা বিভিন্ন শহরে গিয়ে বিক্রি করার কাজে এ খালটিকে ব্যবহার করতো। কিন্তু খালটির পৌরসভা অংশ অবৈধভাবে দখল হয়ে যাওয়ায় খালটি তীব্র ভাবে নাব্যতা সংকটে পড়ে এবং খালটিতে পূর্বের ন্যায় আর নৌযান চলাচল করতে পারেনা। বিশেষ করে গ্রীষ্ম ও শীতকালে ভাটার সময় খালটির পৌরসভা অংশ আরো বেশি পানি শূণ্য হয়ে পড়ে। ফলশ্রæতিতে, মাল বোঝাই কার্গো ও ট্রলারসহ অন্যান্য নৌযান সকালে জোয়ারের সময় বরগুনা শহরে এসে মালামাল ও যাত্রী বোঝাই ও খালাস করে আবার যখন পুনরায় খালে জোয়ার আসে তখন অতিকষ্টে এসব নৌযান গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছেড়েযায়। দিনের বেশীর ভাগ সময় খালটিতে পর্যাপ্ত পানি না থাকার কারণে খালের ৭টি শাখা খাল প্রায় একদম পানি শূন্য হয়ে পড়ে। তাই বছরের বর্ষা মৌসুম বাদে বাকী সময়টাতে পার্শ¦বর্তী গ্রাম গুলোর চাষাবাদও মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে।
স্থানীয় দখলদারদের তালিকা ও খাল পুনরুদ্ধারে স্থানীয় প্রশাসনের ব্যর্থতা
দীর্ঘদিন যাবত লীজ প্রথা(?) বন্ধ থাকলেও বরগুনা জেলার প্রভাবশালী ব্যক্তি ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতারাই মূলত খাল দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মান করে ব্যবসা করে আসছে। তবে কেউ কেউ এ কাজে ভূমি অফিসের কিছু অসাধু ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারটিও তুলে এনেছেন। অথচ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলেও জনগুরুত্বপূর্ণ এই খালটি রক্ষায় বা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন পৌরসভা অংশের দেড় কিলোমিটার এলাকার উভয় পাড়ে ৩০ নং বরগুনা মৌজার ৭৮৯ দাগেরমধ্যে ১৩৫ জন অবৈধ দখলদারের তালিকা করা ছাড়া অন্য কোন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন করতে পারেনি কেননা, স্থানীয় সাংসদ শম্ভু দেবনাথ-এর স্ত্রী মাধবী দেব নাথের নাম ও দখলদারের তালিকায় রয়েছে। এ কারণে হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা ও কৃষি ভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পুনঃরুদ্ধারে ভাড়ানীখাল দখল মুক্ত হওয়া প্রয়োজন মনে করলেও স্থানীয় প্রশাসন আদৌ কোন দিন এ খাল দখল মুক্ত করতে পারবে কিনা সে বিষয় নিয়ে জনসাধারণের মনে সংশয় ছিল সব সময়ই।
খাল পুনঃরুদ্ধারে বেলা’র ভূমিকা
ভাড়ানী খালের অবৈধ দখল-দূষণ ও বিধ সমস্যা সংক্রান্ত সচিত্র প্রতিবেদন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও প্রশাসন এ ব্যাপারে উদাসীন থাকায় গত ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ইং তারিখ স্থানীয় এলাকাবাসী এ খাল উদ্ধারে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)’র প্রধান নির্বাহী বরাবর খাল উদ্ধারে আইনি সহায়তা চেয়ে একটি আবেদনকরলে বেলা বরিশাল অফিস ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখ উক্ত খাল সরজমিন পরিদর্শনে খালের করুণ অবস্থা ও দখল সংক্রান্ত তথ্যাবলী সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত হয়। স্থানীয়দের সাথে আলাপচারিতায় খালের পূর্বাবস্থা ও বর্তমান গুরুত্বের কথা জানতে পারে এবং জনসাধারনের স্বার্থ ও পরিবেশ প্রতিবেশ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে খালটি হতে অবৈধ দখল উচ্ছেদ একান্ত প্রয়োজন বলে মনে করে। এরপর খালটির দখল উচ্ছেদ ও সুষ্ঠু রক্ষনাবেক্ষণের লক্ষ্যে বেলা উচ্চ আদালতে জনস্বার্থে মামলা দায়ের করে (মামলা নং- ১৬০২৭/২০১৮)। মহামান্য আদালত প্রাথমিক শুনানী শেষে ৭ জানুয়ারী ২০১৯ ইং তারিখে ভারানী খাল হতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ না করতে পারা, ভারানী খালের স্বাভাবিক গতিপথ বজায় না রাখতে পারা কেন জনস্বার্থ বিরোধী ও আইন বহির্ভূত হবেনা এবং অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করে খালটিকে কেন পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে এনে সংরক্ষণ করা হবেনা সে মর্মে বিবাদীগণের উপর রুল জারি করলে বরগুনা জেলা প্রশাসন ভূমি অফিস ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগীতায় ৮ও ৯ এপ্রিল ২০১৯ ইং তারিখে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে। এ উচ্ছেদ অভিযানটিকে বরগুনার জেলে, ব্যবসায়ী ও কৃষি পেশার সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ সহ সকল শ্রেনী পেশার মানুষ সাধুবাদ জানায় ও সন্তুষ্টি প্রকাশ করে। পাশাপাশি এ অঞ্চলের সাধারণ জনতা উচ্ছেদ পরবর্তী সময়ে খালটিকে ঘিরে প্রশাসনের কাছে সিএস ম্যাপ অনুসারে খালটির সীমানা নির্ধারণ, পরিকল্পিত খনন, সংযোগ খালে পানি প্রবাহ ফিরিয়ে আনা, খালের উৎস ও পতিত মুখখনন ও খালের দু’পারে ওয়াক ওয়ে নির্মাণসহ সৌন্দর্য বর্ধনের প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করেন। এছাড়া খাকদোন নদীসহ অন্যান্য খালের দখল উচ্ছেদে স্থানীয় জনগন বেলা’র সহযোগিতা কামনা করেন।