‘‘চিংগরিয়া খালের পরিবেশগত সমস্যা এবং সমাধানে করনীয়’’ শীর্ষক
আলোচনা সভা (এফজিডি)
তারিখ: ৭ ডিসেম্বর ২০১৯
স্থান: প্রেসক্লাব মিলনায়তন, কলাপাড়া, পটুয়াখালী।
প্রতিবেদন তৈরী: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯
পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার অন্তর্গত সরকারী খাস খতিয়ান ভূক্ত ৬ নং খেপুপাড়া মৌাজার এস এ ৪৪১,৪৪২,৪৪৩, ৫২৬, ও ৮৪২ নং দাগে কলাপাড়া পৌরসভার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত একমাত্র খাল চিংগরিয়ার খাল। কমপক্ষে প্রায় ৫০০০ (পাঁচ হাজার) সাধারন জনতা প্রতিদিন এই খালের পানি তাদের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করে আসছে। কৃষি কাজ, জলাবদ্ধতা নিরসনসহ পৌরসভা এলাকাকে দূষণমুক্ত রাখার একমাত্র অবলম্বন এই খাল। খাস জমি বন্দোবস্ত নীতিমালায় জনস্বার্থে ব্যবহৃত পানি চলাচলের এই খাল বন্দোবস্তের কোন সুযোগ না থাকলেও বিগত দিনে রবীন্দ্র নাথ দাস নামক এক ব্যক্তির নিকট এই খালটির একটি অংশ লিজ প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে তিনি ভূমি অফিসের কিছু অসাধূ কমর্ক র্তাদের যোগসাজসে উক্ত জায়গা নিজ নামে কাগজপত্র তৈরী করে
নতুন করে আলাদা খতিয়ান (৮১১) খুলে ১.৫৫ একর জায়গা চিরস্থায়ীভাবে ভোগ দখল করার সমস্ত প্রμিয়া সম্পনড়ব করে এবং খালের মধ্যে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে খালের সম্পূর্ন প্রবাহ বন্ধ করে দিয়ে মাছ চাষ শুরু করেন । অন্যদিকে কিছু কিছু ব্যক্তিবর্গ খালের বাকী অংশের কিছু ক্ষেত্রে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে বাড়ীর সংযোগ রা¯াÍ নির্মান ও স্থাপনা তৈরী করেও অবৈধভাবে দখলের চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে এলাকাবাসী জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেও কোন
প্রতিকার না পেয়ে অবৈধ দখল ও বাঁধ অপসারন পূর্বক খালটি জনস্বার্থে উন্মুক্ত করার জন্য আইনগত সহায়তা চেয়ে বেলা’র নিকট আবেদন করে। সবর্ িদক বিবেচনায় স্থানীয় জনতার সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এবং এ সম্পর্কে করনীয় সম্পর্কে জানতে বেলা বরিশাল এ আলোচনা সভার আয়োজন করে। ৭ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে বিভিনড়ব শ্রেণীপেশার মোট ২৩ জন পুরুষ অংশগ্রহণকারীর উপস্থিতিতে প্রেসক্লাব মিলনায়তন,কলাপাড়া, পটুয়াখালীতে এ সভার আয়োজন
করা হয়। কলাপাড়া প্রেসক্লাবের সভাপতি হূমায়ূন কবীর এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ আলোচনা সভার শুরুতেই পরিচয় পর্ব শেষে সভার উদ্দেশ্য ও ইস্যু ভিত্তিক আলোচনা করা হয়। বেলা বরিশালের ফিল্ড ম্যানেজার জনাব লিংকন বায়েন ইস্যু ভিত্তিক আলোচনায় চিংগরিয়া খালের অবৈধ বাঁধের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি, সংশিষ্ট বিধিবিধান এবং এ অব¯া’ নিরসনে নাগরিক সমাজের ভূমিকার কথা সহজ ভাষায় তুলে ধরেন।
মুক্ত আলোচনায় বক্তারা বলেন, ‘‘কলাপাড়া শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত প্রায় ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ খালটি কলাপাড়া পৌরবাসীর এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের জীবন ও জীবিকায় গুরুত্বপূর্ন অবদান রেখে চলেছে। নদী-খাল ও অন্যান্য জলাধার বেষ্টিত এ উপজেলার বেশির ভাগ এলাকাই বর্ষা মৌসুমে, বন্যা ও জলোচ্ছা¡ সের সময় পানিতে সয়লাব হয়ে যায়। পানিতে ডুবে যায় বেশির ভাগ ঘরবাড়ি, ব্যাপক ফসলহানি ঘটে সমুদ্রের লোনা পানিতে।তাই এই উপচে পড়া পানি যাতে সহজেই নিষ্কাসিত হতে পারে সেজন্য এ এলাকায় ¯া^ ধীনতা পরবর্তী সময়ে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট খালের পাশাপাশি নতুন খালও খনন করা হয়। প্রায় বিশ-পঁচিশ বছর যাবত সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকতার্র সহায়তায় একটি প্রভাবশালী কুচμী মহল কলাপাড়া উপজেলার বেশির ভাগ খাল লিজ নিয়ে বা প্রভাব খাটিয়ে সরকারী রেকর্ডীয় খালে অসংখ্য বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ শুরু করে আবার কেউবা লিজ জমি নিজের নামে লিখে নিয়ে অন্যদের কাছে বসতবাড়ি নির্মাণের জন্য অতিরিক্ত মুনাফায় বিμি করে দিয়েছে। যে কারনে একে একে এ অঞ্চলের অধিকাংশ খালই বিলীন হতে চলেছে। তাই বর্ষামৌসুমে এবং জলোচ্ছা¡ সের সময় সাগরের লোনাপানিতে সয়লাব হয়ে যায় কৃষিজমি। তলিয়ে যায় বসতভিটা। এহেন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে কৃষকরা এবং সকল শ্রেণীপেশার সাধারন জনতা প্রশাসনের দ্বারস্থ হলেও কোন সমাধান মিলছে না। বরং প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনবিরোধী কার্যμমই জলাবদ্ধতার মূল কারণ বলে স্থানীয় অধিবাসীরা জানিয়েছেন। কলাপাড়ায় যেসব গুরুত্বপূর্ণ খাল রয়েছে তার মধ্যে চিংগরিয়া খাল অন্যতম। আন্ধারমানিক নদী হতে উৎপনড়ব হয়ে কলাপাড়ার পৌরসভার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে খালটি প্রায় ৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে চাকামইয়া নিশানবাড়িয়া নদীর (দোন) সাথে মিশেছে। জনগুরুত্বপূর্ণ এই খালটি দখল হওয়ার কারনে বিপাকে পড়েছে অসংখ্য মানুষ। শত একর জমি জলাবদ্ধতার শিকার হচ্ছে বর্ষা মৌসুমে এবং অন্যদিকে সমুদ্রের লোনাপানিতে কৃষকদের কৃষিকাজ অনোপযোগী হয়ে পড়ে। এ সময়ে পৌরসভা এবং পার্শ্ববতীর্ এলাকায় পানি জমে তলিয়ে যায় সকল বাসস্থান। খালদিয়ে পানি অপসারিত না হতে পেরে প্লাবনের সময় এসব এলাকায় রা¯াÍ ঘাট পর্যন্ত তলিয়ে যায়। প্রতিনিয়ত সাগর উপকলূ ীয় নদীতে বহে অস্বাভাবিক জোয়ার। আবার হঠাৎ অতিবৃষ্টিতে দেখা দেয় ভয়াবহ জলাবদ্ধতা। অস্বাভাবিক জোয়ার এবং বন্যার সময় বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হয়ে যখন বাড়িঘর ও ফসলের মাঠ পানিতে প্লাবিত হয়ে যায় তখন মানুষের বেঁচে থাকাই দায় হয়ে যায়। জমে থাকা অতিরিক্ত পানি অপসারিত হয়ে থাকে খাল দিয়ে কিন্তু এ এলাকার সরকারী রেকর্ডীয় চিংগরিয়া খালটিতে প্রভাবশালী মহল বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ এবং বিভিনড়ব স্থাপনা নির্মানের কারনে কৃষকের ক্ষেতের লোনা পানি আর অপসারিত হয় না। যে কারনে স্থায়ীভাবে অনাবাদী হয়ে পড়েছে এ এলাকার কৃষিজমি। এ কারনে এখানকার ফসলী জমির মাটির গুনাগুন পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অপর দিকে নিয়মিত খালের পানি প্রবাহ বন্ধ থাকার কারনে সেচের পানির তীব্র সংকটে শুষ্ক মৌসুমেও ফসলের চাষ ব্যাহত হয়। এ অবস্থা হতে উত্তোরন ঘটাতে অর্থাৎ এ এলাকার কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে হলে চিংগরিয়া খালটির বাঁধ অপসারন করা অত্যন্ত জরুরী বলে মনে করেন কৃষিবিভাগ ও এখানকার সব শ্রেণীপেশার মানুষ। কৃষকরা মনে করেন সরকারী খাল যদি তারা নিজেরা নিয়ন্ত্রন করতে পারেন তবেই কৃষিক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবতর্ন আনা সম্ভব। এক্ষেত্রে সরকারকেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে’’।
অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যাশা-
১। খালটির সিএস ম্যাপ অনুযায়ী খালটির সীমানা নির্ধারন।
২। খালের অংশের বন্দোবস্ত দেয়া জমির লিজ বাতিল করার ব্যবস্থা গ্রহন করা
৩। খালের মধ্যেকার অবৈধ স্থাপনা ও বাঁধ অপসারন পূর্বক খালটি খনন করা।
৪। পানি চলাচলে সংযোগকৃত পাইপের পরিবর্তে কালভার্ট নির্মান করা।
৫। ময়লা আবর্জনা পানিতে না ফেলার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ
৬। খালটি উদ্ধারে বেলার আইনগত সহায়তা
অনুষ্ঠানের সভাপতি তার মূল্যবান বক্তব্যে বলেন, ‘‘চিংগরিয়া খাল এক সময়ে কলাপাড়া উপজেলার চাষাবাদ, অর্থনৈতিক ও মালামাল পরিবহনে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করছিল। তখন খালের পানি ছিল পরিস্কার। নৌকায় করে উপজেলার লোকজন এই খাল ধরে যাতায়াত করত। কিন্তু ¯া^ ধীনতার পরবর্তী সময়ে খালটির হারানো ঐতিহ্য আর গুরুত্ব শোনা যাচ্ছে। খালকে ঘিরে টিকে থাকা হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা মুখ থুবড়ে পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে কৃষি ভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ভবিষ্যতে অন্ধকারে হারিয়ে যাবে। ব্রীজ নির্মান না করে খালের উপর দিয়ে পাকা সড়ক নির্মাণ এবং অবৈধ দখল করে বসতবাড়ি ও অন্যান্য স্থাপনা তৈরী করার কারনে দিনে দিনে খালটি বিলীন হতে চলেছে। এক সময় খালটির প্রস্থ ৩০-৪০ ফুট হলেও খালের পাশে রাস্তা নির্মাণ ও উভয় পাড়ে দখলদারিত্বের কারনে উহা সংকোচিত করে ফেলা হয়েছে। এই অবস্থায় এই খালটিকে মৃত ঘোষনা এখন সময়ের ব্যাপার। উপরোক্ত কারনে মৃত প্রায় চিংগরিয়া খালে অবাধে পানি প্রবাহ মারাত্বক ভাবে বাধা গ্রস্থ হচ্ছে ফলে খালের উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করা কৃষকের অবস্থা দিন দিন করুন হয়ে যাচ্ছে এবং কৃষি উৎপাদনে মারাত্বক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। খালের দুই তীরে অবৈধ স্থাপনা ও সময় অনুযায়ী খনন না হওয়ায় একসময়ের খরস্রোতা এই খালের পানি প্রবাহের ¯া^ ভাবিক গতি বিঘিতড়ব হচ্ছে, গভীরতাও কমেছে বিভিনড়ব স্থানে। মাঝে মাঝে দেখা গেছে অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা, বাঁধ ও ময়লার স্তুপ। এসব ময়লার স্তুপ আর প্রতিবছরই নতুন নতুন অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠলেও খালটিকে বাচাঁতে ও দখলদারদের থামাতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। তাই তিনি চিংগরিয়া খালে প্রাšিকÍ কৃষক ও জেলেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও জীবন জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং এলাকার খাদ্য ঘাটতি পূরণে খালটি সম্পূর্ন রুপে উন্মুক্ত করে দেওয়ার জন্য বেলা’র পক্ষ থেকে আইনী সহায়তার আহবান জানিয়ে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন’’।