‘‘কীর্তনখোলা নদী রক্ষায় গণস্বাক্ষর অভিযান’’
আয়োজনেঃ বেলা, বরিশাল অফিস
স্থান: বরিশাল সদর, বরিশাল।
সময়কাল: ৫-৩০ অক্টোবর ২০১৯
১৮০১ সালে আড়িয়াল খাঁ নদী থেকে উৎপনড়ব যে জলধারা বরিশাল নগরীকে ছুঁয়ে দক্ষিনে নলছিটির নিকট সুগন্ধা এবং ঝালকাঠির নিকট বিষখালী নদীর সাথে মিশেছে তাকে বরিশাল নদী বলা হত। সরকারি খাস হিসেবে চিহ্নিত চরকাউয়া,দক্ষিণ চর আইচা, চরআবদানী, চরবাড়িয়া ও লামছড়ি মৌজার বরিশাল নদীই প্রায় দুশো বছর আগে কীর্তনখোলা নামে পরিচিতি লাভ করেছে। উন্মুক্ত ও ইজারাহীন ৭৮৫.৩১ একর ভূমি বেষ্টিত এই কীর্তনখোলা প্রায় ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ। বরিশালে রেল লাইন নেই। এই নদী পথেই ১৮৮০ সাল থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সাথে বরিশালের এবং বরিশাল জেলা শহরের সাথে খুলনা সহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের ষ্টীমার-লঞ্চ সার্ভিসের মাধ্যমে নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। তখন প্রমত্তা কীর্তনখোলার দু’কুল জুড়ে ছিল সারি-সারি ঝাউ বৃক্ষরাজির সমারোহ, ছিল সুন্দরী গাছের আধিক্য আর অনেকটা চরবেষ্টিত পরিবেশ। এই নদী ও শহরের রূপসৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বরিশালকে ‘বাংলার ভেনিস’ বলেছিলেন কবি কাজী নজরুল। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ লিখেছেন- ‘তোমার যেখানে সাধ চলে যাও-আমি এই বাংলার পরে রয়ে যাব।’ সময়ের বিবর্তনে কীর্তনখোলার সেই সৌন্দর্য ধূয়ে মুছে গেছে। স্রোত¯িন^ ী উন্মুক্ত এ নদীর তীরে তীরে এখন গড়ে উঠেছে বহু অবৈধ স্থাপনা, শিল্প ও বর্জ্য দূষণ μমাগত চলছেই। এ নদীর সংযোগ খাল ও শাখানদীতে অপরিকল্পিত ¯ুইø সগেট ও বাঁধ নির্মানের ফলে পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে। যে কারনে এর বক্ষে পলি জমে নাব্যতা সংকট দেখা দিয়েছে। বিভিনড়ব স্থানে জেগে উঠেছে বিশাল চর। সে সেব স্থানে গড়ে উঠেছে হাজারো মানুষের অবৈধ বসতি। ভাটার সময়ে অনেক স্থানে জেগে ওঠে অসংখ্য ডুবোচর। যা শুষ্ক মৌসুমে নৌযান চলাচলের ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করছে। আবার এ সব ডুবোচর থেকে এক শেন্র ীর অসাধু
ব্যক্তিরা অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলন করছে। দিনে দিনে শুকিয়ে যাচ্ছে এর শাখা নদী ও সংযোগ খাল। যে কারনে এ নদীর উপক‚লবর্তী এলাকার ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বাড়ছে খাদ্য সংকট, জনজীবনে নেমে এসেছে চরম দূভোর্গ । আবার বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টি, বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারনে হঠাৎ ধেয়ে আসা বিপুল জলরাশির আঘাতে ভেঙ্গে পরে এ নদীর তীরের অসম্পূর্ণ শহর রক্ষা বাঁধ, উভয় পারের ভূমি ধ্বসে মারাত্মক নদী ভাঙনের সৃষ্টি হয়। এ কারনে অগনিত মানুষ হারাচ্ছে বাসস্থান এবং কালে কালে এ নদীর গতিপথও পরিবর্তিত হচ্ছে। আবার এই নদীরই কিনার ঘেঁষে গড়ে উঠেছে অবৈধভাবে অসংখ্য ইটের ভাটা। নদীর দপদপিয়া অংশে বালু ফেলে ভরাট করার মহোৎসব চলছে এবং এখানে প্রধান প্রধান শিল্প প্রতিষ্ঠানের কেমিক্যাল দূষণ ভয়াবহ রূপ লাভ করেছে। এছাড়াও নদীতীরে ছোট ছোট লৌহ, অ্যালুমিনিয়ামজাত শিল্প প্রতিষ্ঠান,মৎস্যপ্রμিয়াজাত কারখানা কীর্তন খোলার স্বচ্ছ পানিকে μমশ দূষণ করে চলেছে। কীর্তনখোলার দূষণ এ মূহুর্তে ঢাকার বুড়িগঙ্গার মত ভয়াবহ না হলেও দূষণ পরিস্থিতি μমশ বিপজ্জনক রূপলাভ করেছে। অদূর ভবিষ্যতে এই নদী মৃতনদী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পূর্বেই ব্যব¯া’ নেয়ার সময় এসেছে। বরিশাল মহানগরীর পত্তনের সময় এর জনসংখ্যা ৬ হাজার থাকলেও এখন এ নগরীর ৪৫ বর্গমাইলে বাস করছে প্রায় ৬ লক্ষ মানুষ। এ সব মানুষের গৃহসং¯া’ ন,শিল্প, যোগাযোগ, মৎস্যচাষ, সেচ ব্যবস্থা,বিনোদন এই নদী ঘিরে গড়ে উঠলেও এই নদীর স্বচ্ছ পানিপ্রবাহ বজায় রাখতে কোন সরকারী প্রচেষ্টা দেখা যায়নি। বরিশাল নগরবাসীর সচেতন অংশের মধ্যে দাবী উঠেছে ‘‘কীর্তনখোলা বাঁচাও-বরিশাল বাঁচাও’’। এ কারনেই বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), বরিশাল অফিস ঐতিহ্যবাহী এ নদী রক্ষায় জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে ‘দখল-দূষণ রোধ করি, কীর্তনখোলা নদী রক্ষা করি’ শ্লোগাণকে সামনে রেখে ‘‘গণস্বাক্ষর অভিযান’’ কার্যμম পরিচালনা করেছে। সকল শ্রেণী পেশার মানুষ স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে এ গণ¯া^ ক্ষর অভিযানে অংশগ্রহন করে। ঐতিহ্যবাহী এ নদী রক্ষায় বরিশালের মোট ৬,১৫০ জন নাগরিক গণ¯া^ ক্ষর দিয়ে নদী রক্ষায় তাদের দাবী তুলে ধরেন। বেলা’র এ মহতি উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে স্বাক্ষরতা অভিযানে সহযোগীতা করছে ইয়ু এন্ডিং হাঙ্গার, ইয়ু প্লান ফর সোসাইটি, দি অডেশাস, বিডি ক্লিন বরিশাল, বøাড ডোনারস ক্লাব বরিশাল, প্রান্তজন, রান ও সিডিপি বরিশাল। বেলা’র এ কর্মকান্ডের মাধ্যমে বরিশালের সচেতন নাগরিকরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর প্রতি যে গণদাবী তুলে ধরেছেন তা নি¤ড়বরুপঃ
(১)কীর্তনখোলা নদী ও তার শাখানদী এবং খালগুলো সি এস মৌজা ম্যাপ অনুসরন করে ডাটাবেজ তৈরী করা।
(২) ড্রেজিং এর মাধ্যমে নদীর সাথে শাখা নদী ও খালের উৎসমুখ ও পতনমুখসমূহ সচল করা।
(৩) নদীতে কোন অবস্থাতে শিল্প কারখানার রাসায়নিক, কঠিন, প্লাস্টিক, ক্লিনিক্যাল বর্জ্য না ফেলা।
(৪) নদী-খাল দখল ও দূষণ রোধে ‘বিশেষ ট্রাইব্যুনাল’ গঠন করে অভিযুক্তদের নিকট হতে ক্ষতিপূরন আদায়পূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করে নদীর স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখা।
(৫) নদী-খাল সুরক্ষায় প্রতি মাসে ন্যূনতম একবার মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা।
(৬) নদী-খাল সুরক্ষায় প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে দৃঢ়ভাবে নদী-বান্ধব নীতি অনুসরন করা।
(৭) নদী ভাঙ্গনের কবল হতে রক্ষাপেতে টেকসই বাঁধ নির্মাণ
(৮) কীর্তনখোলা নদীসহ বরিশালের অন্যান্য নদী-খাল সুরক্ষা, গতিপথ, নাব্যতা ও পানিপ্রবাহ সচল রাখতে জাতীয় বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা ইত্যাদি।
এ সকল দাবীর পাশাপাশি বেলা, বরিশাল অফিস মনে করে, ‘‘দক্ষিণাঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা, পরিবেশপ্রতিে বশ, যাতায়াত সুরক্ষার স্বার্থে কীর্তনখোলা নদীসহ বরিশাল অঞ্চলের নদী-খালসমূহ দখল-দূষণমুক্ত রাখার জন্য সকলকে আরো ঐক্যবদ্ধ ও সোচ্চার হতে হবে।